প্রধানমন্ত্রীকে ‘সরি’ বললেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল

৩০ জুলাই, ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী আপনি বলেন স্বজন হারানোর বেদনা আপনি বোঝেন। সরি, আমার কাছে মনে হয় স্বজন হারানোর বেদনা আপনি শুধু নিজেরটা বোঝেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘নাশকতার জন্য দশ-বিশ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছেন। সম্ভবত শুধু ঢাকা শহরে আড়াই লাখ আসামি। হত্যা মামলায় কয়জনকে গ্রেপ্তার করেছেন? প্রধানমন্ত্রী আপনি বলেন স্বজন হারানোর বেদনা আপনি বোঝেন। সরি, আমার কাছে মনে হয় স্বজন হারানোর বেদনা আপনি শুধু নিজেরটা বোঝেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা পত্রিকা, ফুটেজে দেখেছি ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাতে অস্ত্র। যা কি না পত্রিকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ চিহ্নিত করে লেখা হয়েছে। পোশাক পরা পুলিশের স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও তাদের গ্রেপ্তার করছেন না। নাশকতা কে করেছে, কোনো ফুটেজ তো দেখিনি। কোনো ভিন্নমতের দলের নেতার নির্দেশ তো দেখিনি যে নাশকতা করতে বলেছে; হতে পারে তারা জড়িত রয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই এখনো। প্রমাণের আগেই হাজার দশেক গ্রেপ্তার করে ফেলেছেন। আর যেখানে স্পষ্ট প্রমাণ আছে...! মানুষের জীবন সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার কারণে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। দশজনের মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতা ছেড়ে চলে গেছেন। তারও কম দম্ভ ছিল না, কম শক্তি ছিল না, কম সেনাসদস্য ছিল না, কম পুলিশ ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘আজ দশজন শুধু শিশু-কিশোর মারা গেছেন, মানুষ মারা গেছেন অন্তত ২৬৭ জন। আপনার পদত্যাগের দাবিতে সারা বাংলাদেশের মানুষ গণ-আন্দোলন করছে না, সেটাই আপনার সৌভাগ্য। আমাদের সেদিকে ধাবিত করবেন না। হত্যাকারীর বিচার করেন, গণরুম কেন্দ্রিক টর্চার সেলের অবসান ঘটান।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আজ যেসব মন্ত্রীদের কথা বলা হয়েছে। আমরা দম্ভ দেখেছি, গুলি বর্ষণের কথা পর্যন্ত শুনেছি। একজন মন্ত্রী নাকি বলেছেন, আপনারা চেক করবেন, তাদের কাছে না কি এত গুলি রয়েছে যে প্রতি সেকেন্ডে গুলি করলেও পাঁচ বছরে শেষ হবে না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি এদের বিচার করতে না পারেন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন। মানুষের বুকের ক্ষত দূর করেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষকে আরও উত্তেজিত করে, মানুষের আরও ক্ষত বাড়িয়ে কীভাবে চান সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। সবকিছু যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে তো মুক্তিযুদ্ধ করতাম না, ৯০-এর আন্দোলন করতাম না।’

তিনি বলেন, ‘ডাকসুর একজন নির্বাচিত সাবেক প্রতিনিধি ভিপি নুরুল হক নুরকে কীভাবে টর্চার করা হয়েছে রিমান্ডে। রিমান্ডে এভাবে টর্চার বাংলাদেশের সংবিধান আর্টিকেল ৩৫-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রিমান্ডে নাহিদকে যে অত্যাচার করা হয়েছে, তার শরীরে আমরা যে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি- এসব সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রিমান্ডে নুরকে এভাবে মারার পর আবার রিমান্ড দেয় আদালত! এটা কোন আদালত?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমি আইনের শিক্ষক। এটা কোন আদালত? সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতির কাছে আমার আহ্বান, রিমান্ডের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে নিম্ন আদালত কীভাবে আবার তাদের রিমান্ডের আদেশ দিচ্ছে। আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।’

তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলের ও ভিন্ন মতের যে মানুষই যায়, তাকে রিমান্ডে দিয়ে দেয়। রিমান্ড দেয়া কি বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনে পরিণত হয়েছে, রিমান্ড দিতে হবে? নিম্ন আদালত কেন কাজ করতে পারছে না? নিম্ন আদালতের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা হচ্ছে শেষ নিয়মের মাধ্যমে। আমি উচ্চ আদালতের কাছে প্রার্থনা করব, আপনারা স্বপ্রণোদিতভাবে অনেক ব্যবস্থা নিতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জোরপূর্বক কেন সমন্বয়ককে তুলে নেওয়া হয়েছে? এই ডিবির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। আমরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকি, আপনারা সংবিধানের রক্ষক। আপনাদের কাছে আপিল করছি, সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের যে লঙ্ঘন হচ্ছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার কথা। চোখের সামনে সংবিধান লঙ্ঘন করছে। আর্টিকেল ৩৩, ৩৫ লঙ্ঘন করছে, গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে। চোখের সামনে, দম্ভ ভরে করছে। উচ্চ আদালতের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা স্বপ্রণোদিতভাবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আজ কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলনে দেশের যত মানুষ রয়েছেন, যত ছাত্র-তরুণ-জনতা রয়েছেন, তারা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকৃত বাহক। আর এদের ওপর যারা গুলি চালাচ্ছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে, নির্যাতন করছে, গণ গ্রেপ্তার করছে, তারা হচ্ছে ২০২৪ সালের রাজাকার।’

ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহাসিক একটি ঘটনা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন,রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। কিন্তু বর্তমান সরকারে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিরা, আপনাদের সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, আপনাদের বুকের মধ্যে এই প্রত্যয় জন্ম নিয়েছে- রক্ত যখন নিয়েছি, আরও রক্ত নেব। বাংলাদেশের ভিন্ন মতকারীদের নিশ্চিহ্ন করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।’