শাসক, পদ-পদবি সম্পর্কে ইসলামি নির্দেশনা

০৬ আগস্ট, ২০২৪

ইসলামে সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ। ‘নিশ্চয়ই এই পৃথিবী আল্লাহর, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করেন।’ (সুরা আরাফ: ১২৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো আর যাকে ইচ্ছা করো লাঞ্ছিত...।’ (সুরা আলে ইমরান: ২৬)

মানুষকে ক্ষমতা দেওয়া মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একদিকে পুরস্কার, অন্যদিকে আমানতস্বরূপ। এই আমানতের খেয়ানত যেন না হয়ে, সেজন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিই ক্ষমতা নেবেন। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের অবশ্যই বিশেষ কিছু গুণ থাকতে হবে। যেমন—১. রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই ঈমানদার তথা এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হতে হবে। ২. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বগুলো উত্তমরূপে পালনের যোগ্যতা। ৩. রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি এবং বুদ্ধিমত্তায় সর্বাগ্রসর। নিছক প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ও উত্তম নেতৃত্বের গুণাবলীই ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। ৪. রাষ্ট্রনেতাকে ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষতা ও সুবিচারের অধিকারী হতে হবে। ৫. পুরুষ হতে হবে। কারণ নারীরা অনেক সময় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে পারেন না। তাঁদের হৃদয় কোমলতা ও স্নেহে ভরপুর। ৬. আইন-জ্ঞানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা থাকতে হবে। ৭. দেশের স্বাধীন নাগরিক হতে হবে। ৮. জন্মসূত্রে পবিত্র হতে হবে। অবৈধ সন্তান হতে পারবে না। কোনো কৃপণ, মূর্খ, নির্দয়, অন্য রাষ্ট্রের ভিন্নতর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট, ঘুষখোর, রাসুলের সুন্নত উপেক্ষাকারী ব্যক্তি মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না।

ইসলামের নির্দেশনা হলো- দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নেওয়া যাবে না। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ। আমরা এমন কাউকে ক্ষমতায় নিযুক্ত করব না, যে দায়িত্ব চায় এবং এমন লোককেও না, যে দায়িত্ব লাভের প্রত্যাশা করে।’ আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, প্রিয়নবী (স.) আমাকে বলেছেন, হে আবদুর রহমান, দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ে নিয়ো না। কারণ যদি তোমার চাওয়ার কারণে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তো তোমাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দেওয়া হবে (তুমি আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে)। পক্ষান্তরে যদি না চাইতেই দায়িত্ব ও ক্ষমতা তোমার ওপর অর্পিত হয়, তাহলে তুমি ওই বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। (বুখারি: ৬৬২২)

ক্ষমতালাভের পর মানবতা ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখা দায়িত্ব ও কর্তব্য। সর্বোপরি কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা একজন দায়িত্বশীলের প্রধান কর্তব্য। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা আমানত হকদারের কাছে অর্পণ করো। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে, আল্লাহ তোমাদের কতই না উত্তম উপদেশ দেন, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী, তোমাদের কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও রাসুলের কাছে উপস্থাপন করো, এটাই উত্তম ও পরিণামে সুন্দরতর।’ (সুরা নিসা: ৫৯-৫৮)

নবী (স.) বলেন, ‘কেউ যদি মুসলিম জনগোষ্ঠীর শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে প্রতারক ও আত্মসাৎকারী হিসেবে মারা যায়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি) হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি)

নবীজি (স.) ক্ষমতালাভের পর তিন স্তরের প্রশাসন কাঠামো গড়ে তোলেন—কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক। কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন দপ্তরে ভাগ করে বিশিষ্ট সাহাবিদের দায়িত্ব প্রদান করেন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য প্রাদেশিক পর্যায়ে নিযুক্ত হন ওয়ালি বা গভর্নর। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের জন্য আমিল বা আঞ্চলিক প্রশাসকের পদ সৃষ্টি করা হয়।

ক্ষমতা শক্তির মানদণ্ড নয়; চিরস্থায়ী বস্তুও নয়— এই চিরন্তন কথাটি সবসময় স্মরণ রাখতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই দিনগুলোর (সুদিন-দুর্দিন ও জয়-পরাজয়) পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪০)

ক্ষমতা পেয়ে ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করা, নীতিভ্রষ্ট হওয়া ও খেয়ালখুশিমতো কাজ করা যাবে না। এর পরিণতি দুনিয়াতেই রয়েছে, আবার আখেরাতের মর্যাদা ও কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি সেসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম শুধু আল্লাহভীরুদের জন্য।’ (সুরা কাসাস: ৮৩)

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার পায়জামা। যে ব্যক্তি আমার ওই দুই বস্তু টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (আবু দাউদ: ৪০৯০) 

অন্যদিকে ন্যায়পরায়ণ শাসকদের জন্য ইহকাল ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। ইয়াদ বিন হিমার আল-মুজাশেয়ি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, জান্নাতে তিন শ্রেণির লোক থাকবে। ক্ষমতাসীন ন্যায়পরায়ণ শাসক, মুসলিম ও আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ এবং বড় পরিবার নিয়ে যিনি নিষ্কলুষ পবিত্র জীবন যাপন করেন। (মুসলিম: ২৮৬৫)

হাদিসের বর্ণনানুযায়ী, উত্তম শাসক তারাই, যারা জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত, জনগণও তাদের মঙ্গল কামনা করে। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, আমি তোমাদের উত্তম ও নিকৃষ্ট শাসকদের সম্পর্কে জানাব না? উত্তম শাসক হলো যাদের তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদের ভালোবাসে। তোমরা তাদের জন্য দোয়া করো এবং তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করে। নিকৃষ্ট শাসক হলো যাদের তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদের অভিশাপ দাও এবং তারাও তোমাদের অভিশাপ দেয়। (তিরমিজি: ২২৬৪)

দ্বীনে ইসলাম বিস্তৃত হয় আদর্শগত কারণে। প্রিয়নবী (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে খলিফা ওমর (রা.) হয়ে যান অর্ধ পৃথিবীর বাদশাহ। যাঁর সুশাসনের নজির হলো, জেরুজালেম বিজয়ী আমিরুল মুমিনিন টেনে নিচ্ছেন উটের রশি। ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাতের আঁধারে। তিনি বলতেন, ‘ওই ফোরাতের কূলে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমি ওমরকে আল্লাহর সমীপে জবাবদিহি করতে হবে!’ আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।