ইসলামের দৃষ্টিতে বিজয়ীদের করণীয়

০৮ আগস্ট, ২০২৪

ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ মহান আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে খুশি তাকে ক্ষমতা দান করেন। সুতরাং যারা কোনোভাবে বিজয়ী বা ক্ষমতাসীন হয়, তাদের উচিত মহান আল্লাহর নির্দেশনা মান্য করা। যেন জনকল্যাণ ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

আল্লাহর বিধান অনিবার্য

মুমিনের জন্য দেশ পরিচালনায় মহান আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই অবিশ্বাসী।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৪)

বিজয়ী দলের করণীয়

কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিজয়ী দলের কিছু করণীয় তুলে ধরা হলো—

১. দায়িত্বকে আমানত মনে করা : দেশ পরিচালনার যে দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে বিজয়ী দল তাকে আমানত মনে করবে। আবু জর (রা.) বলেন, আমি আবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি আমাকে প্রশাসক পদ প্রদান করবেন? বর্ণনাকারী বলেন, তিনি তখন তাঁর হাত দিয়ে আমার কাঁধে আঘাত করে বললেন, হে আবু জর! তুমি দুর্বল অথচ এটি হচ্ছে একটি আমানত।
আর কিয়ামতের দিন এটা হবে লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা। তবে যে এর হক সম্পূর্ণ আদায় করবে তার কথা ভিন্ন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬১৩)
২. দেশের কল্যাণে কাজ করা : আল্লাহ যাদের বিজয়ী করেছেন তাদের উচিত দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা। এটাই একজন আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এমন আমির বা নেতা, যার ওপর মুসলিমদের শাসনক্ষমতা অর্পিত হয় অথচ এরপর সে তাদের কল্যাণ সাধনে চেষ্টা না করে বা তাদের মঙ্গল কামনা না করে; আল্লাহ তাকে তাদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬২৭)
৩. জনকল্যাণ নিশ্চিত করা : আবু মারইয়াম আজদি (রা.) বলেন, আমি মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে গেলে তিনি বলেন, হে অমুক, আমার কাছে আপনার আগমন সুস্বাগতম! এটা আরবদের বাকরীতি। আমি বললাম, আমি একটি হাদিস শুনেছি যা আপনাকে জানাব। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে মুসলিমদের কোনো দায়িত্বে নিয়োগ করলে যদি সে তাদের প্রয়োজন পূরণ ও অভাবের সময় দূরে আড়ালে থাকে তখন মহান আল্লাহও তার প্রয়োজন পূরণ ও অভাব-অনটন দূর করা হতে দূরে থাকবেন। অতঃপর মুয়াবিয়া (রা.) জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণের জন্য এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন।
(সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ২৯৪৮)
৪. দেশ পরিচালনায় যোগ্য লোক নিয়োগ : বিজয়ী দল মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে যোগ্য লোক নিয়োগ দেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দল থেকে কোনো ব্যক্তিকে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দিল। অথচ সে দলে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির চেয়ে আল্লাহর অধিক প্রিয় ব্যক্তি ছিল, সে আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুমিনদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করল।’

(আত-তারগিব ওয়াত তারহিব : ৩/১৯৩)

৫. পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিহার : বিজয়ী দল দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ পরিহার করবে। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারেও। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোনো বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলো, অতঃপর তাদের ওপর কাউকে পক্ষপাতমূলকভাবে নিয়োগ দেয়, তার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ। আল্লাহ তার থেকে কোনো দান ও ন্যায়বিচার গ্রহণ করবেন না এবং তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (আত-তারগিব ওয়াত তারহিব: ৩/১৯৩)

৬. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’

(সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

৭. বিশেষজ্ঞ লোকের পরামর্শ গ্রহণ : যারা বিজয়ী এবং যারা দেশ পরিচালনার কাজে নিযুক্ত হয় তাদের দায়িত্ব হলো দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা এবং সব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করবে। নিম্নোক্ত আয়াত থেকে যেমনটি ধারণা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন। আমি উত্তম রক্ষক, সুবিজ্ঞ।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৫)

৮. সত্য আড়াল না করা : বিজয়ী দল দেশ পরিচালনার সময় দেশের প্রকৃত অবস্থা মানুষ থেকে আড়াল করবে না, বরং সত্য তুলে ধরবে, যেন তারা আত্মরক্ষার সুযোগ পায় এবং সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে বান্দাকে আল্লাহ প্রজা সাধারণের ওপর দায়িত্বশীল করেন অথচ সে যখন মারা যায় তখনো সে তার প্রজা সাধারণের প্রতি প্রতারণাকারী থাকে, তবে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন।’

(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬২৩)

৯. পরকালীন জবাবদিহিকে ভয় করা : বিজয়ী দল দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পরকালীন জবাবদিহিকে ভয় করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্ববান এবং প্রত্যেকেই তার অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা তার অধীনদের ব্যাপারে দায়িত্ববান এবং সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬১৮)

১০. আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করা : মানুষ পৃথিবীতে মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। সুতরাং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে প্রতিনিধিত্বের স্বাক্ষর রাখবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩০)

সুশাসনের সুফল

খলিফা ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.)-এর প্রতি হাসান বসরি (রহ.)-এর ঐতিহাসিক অসিয়ত থেকে সুশাসনের সুফল ও আদর্শ শাসকের গুণাবলি জানা যায়। তিনি বলেন, হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি জেনে রাখুন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ শাসককে সব ভারসাম্যহীন বস্তুর জন্য ভারসাম্য, পাপীর জন্য পরিশুদ্ধি, বিশৃঙ্খলার জন্য শৃঙ্খলা, দুর্বলের জন্য শক্তি, মাজলুমের জন্য মুক্তি এবং অত্যাচারীর জন্য ভীতিস্বরূপ বানিয়েছেন।

(সিরাতু ওমর ইবনুল আবদিল আজিজ, পৃষ্ঠা-৯৩)