তরুণদের প্রতি নবীজির কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ

১২ আগস্ট, ২০২৪

মানুষের জীবনে তারুণ্য সবচেয়ে দামী ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারুণ্যের সময়টি নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সাধারণত ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের তরুণ বিবেচনা করা হয়। কোরআন ও হাদিসে তরুণদের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা রয়েছে। তরুণ বয়সে আল্লাহদ্রোহিতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ও ইবাদতের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতেও লেখা হয়েছে তারুণ্যের জয়গান। মহানবী (স.) তরুণ সাহাবিদের বিভিন্ন সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো।

১. ভরসা রাখবে আল্লাহর ওপর
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, একদিন তিনি বাহনে রাসুল (স.)-এর পেছনে ছিলেন। তখন রাসুল (স.) তাঁকে বলেছেন, ‘হে কিশোর, আমি তোমাকে কিছু কথা শেখাব। তুমি আল্লাহর নির্দেশ সংরক্ষণ করবে। তোমাকেও তিনি সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর নির্দেশনা পালন করবে, তুমি তাঁকে তোমার সামনে পাবে। কোনো কিছু চাইলে আল্লাহর কাছে চাও। কারো কাছে সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। জেনে রাখো, পুরো জাতি তোমার উপকার করতে চাইলেও আল্লাহ যতটুকু তোমার জন্য লিখে রেখেছেন ততটুকুই হবে। তারা তোমার ক্ষতি করতে চাইলেও আল্লাহ যতটুকু তোমার জন্য লিখে রেখেছেন ততটুকু হবে। (কারণ তাকদিরের) কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠাগুলো শুকিয়ে গেছে।’ (তিরমিজি: ২৫১৬)

২. আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করো
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সাত ধরনের ব্যক্তিকে আরশের নিচে ছায়া দেবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। (তারা হলেন) এক. ন্যায়পরায়ণ শাসক। দুই. এমন যুবক (ও যুবতী), যে রবের ইবাদতে (জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে) বেড়ে উঠেছে। তিন. এমন ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। চার. যে দুই ব্যক্তি আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, তার সন্তুষ্টির জন্য একত্রিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়। পাঁচ. ওই ব্যক্তি, যাকে সুন্দরী ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নারী ডাক দিলেও সে জবাবে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ছয়. যে ব্যক্তি এমনভাবে সদকা করে যে তার বাম হাত জানে না তার ডান হাত কী দিয়েছে। সাত. যে ব্যক্তি একাকিত্বে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়।’ (বুখারি: ১৪২৩)

৩. সামর্থ্যবান হলে বিয়ে করে নাও
আলকামা (রহ.) বর্ণনা করেছেন, আমি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এ সময় ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বললেন, হে আবু আবদুর রহমান, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। তারা পৃথক হয়ে কথা বললেন। ওসমান (রা.) বললেন, হে আবু আবদুর রহমান, আমরা তোমাকে পুনরায় বিয়ে দিতে চাই, তোমার কী মত? এতে তোমার আগের কথা মনে পড়বে। অতঃপর তিনি বললেন, রাসুল (স.) আমাদের বলেছিলেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়, তোমাদের কেউ সামর্থ্যবান হলে সে যেন বিয়ে করে। কেননা তা দৃষ্টি রক্ষা করে এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করে। আর কেউ তা না পারলে সে যেন রোজা রাখে। কারণ তা তাকে নিয়ন্ত্রণ রাখবে।’ (সহিহ বুখারি: ৫০৬৫)

৪. পরিবার-পরিজনকে সময় দাও
মালিক বিন আল হুওয়াইরিস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে আসি। আমরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক ছিলাম। মহানবী (স.)-এর কাছে আমরা প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত অবস্থান করি। রাসুল (স.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহপরায়ণ। তিনি ভাবলেন যে আমরা হয়তো পরিবারের সাক্ষাৎ করতে চাইছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কে কে আত্মীয়-স্বজন রেখে এসেছে? আমরা তাঁকে বললাম। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তোমাদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও। তাদের শিক্ষা দাও। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ জানাও। আর নামাজের সময় যেন তোমাদের একজন আজান দেয়। অতঃপর তোমাদের কোনো প্রবীণ ব্যক্তি যেন তোমাদের ইমাম হন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩১) 

৫. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো
মুআজ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুল (স.) আমাকে বলেছেন, ‘হে মুআজ, আল্লাহর শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আল্লাহর শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ অতঃপর তিনি বলেছেন, ‘হে মুআজ, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি প্রত্যেক নামাজের পর কখনো এই দোয়া পড়া ছাড়বে না- আল্লাহুম্মা আইন্নি আলা জিকরিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদিকা।’ অর্থ: হে আল্লাহ, আমাকে সহযোগিতা করুন যেন আমি আপনাকে স্মরণ করি, কৃতজ্ঞতা জানাই ও আপনার ইবাদত সুন্দরভাবে করি। (আবু দাউদ: ১৫২২) 

৬. ইলম অর্জন করো
জায়েদ বিন সাবিত (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (স.) মদিনা আগমন করলে আমার বাবা আমাকে নিয়ে তাঁর কাছে যান। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল, এ কিশোর বনু নাজ্জার গোত্রের সন্তান। ইতিমধ্যে সে আপনার ওপর মহান আল্লাহর অবতীর্ণ কোরআনের প্রায় ১০টি সুরা মুখস্থ করেছে। এ কথা শুনে রাসুল (স.) খুবই মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন, ‘হে জায়েদ, তুমি আমার জন্য ইহুদিদের কিতাব শিখে নাও। আল্লাহর শপথ, আমি নিজের কিতাবের ব্যাপারে ইহুদিদের নিরাপদ মনে করি না।’ জায়েদ (রা.) বলেন, অতঃপর আমি তাদের কিতাব শিখতে শুরু করি। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই আমি তাতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করি। আমি রাসুল (স.)-কে তাদের পাঠানো চিঠিপত্র পড়ে শোনাতাম। তাঁর পক্ষ থেকে চিঠির উত্তর দেওয়া হতো। (সহিহ বুখারি: ৭১৯৫)

৭. নিজের জন্য যা পছন্দ করো তা অন্যদের জন্যও করো এবং বেশি হাসা পরিহার করো
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‌‘হে আবু হুরাইরা, আল্লাহভীরু হও- অর্থাৎ সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করো, তুমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ইবাদতগুজার হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ প্রদত্ত রিজিকে সন্তুষ্ট হও, সবচেয়ে ধনী হবে। তুমি নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য যা পছন্দ করো তা অন্য মুসলিম ও মুমিনের জন্য পছন্দ করো। নিজের জন্য যা অপছন্দ করো তা অন্যের জন্য অপছন্দ করো। তাহলে তুমি পরিপূর্ণ মুমিন বলে গণ্য হবে। পড়শীর সঙ্গে সুন্দরভাবে থাকো, তুমি পরিপূর্ণ মুসলিম বলে গণ্য হবে। বেশি হাসা পরিহার করো। কারণ বেশি হাসা অন্তর মৃত হওয়ার মতো।’ (তিরমিজি: ২৩০৫) 

৮. যথাযথ ইবাদত করবে, শিরক করবে না, জিহ্বা নিয়ন্ত্রণে রাখবে
মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) বর্ণনা করেছেন, একবার আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। একদিন সকালে তাঁর পাশ দিয়ে চলছিলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন আমল সম্পর্কে বলুন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। তিনি বললে, ‌‘তুমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করেছ। তবে আল্লাহ সহজ করলে তা করা সহজ। তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত দেবে, রমজানে রোজা রাখবে ও  হজ করবে।’ অতঃপর বলেন, ‘আমি কি তোমাকে কল্যাণের পথ দেখাব না? রোজ ঢালের মতো, সদকা পাপ মোচন করে যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়। গভীর রাতে নামাজ আদায় করা। তিনি তেলাওয়াত করেন, ‘তারা বিছানা ত্যাগ করেন, মহান রবের কাছে দোয়া করেন।’ (সুরা সিজদা: ১৬)। ... তিনি বললেন, ‌‘আমি কি তোমাকে এসব কিছুর মূলকথা বলব না? আমি বললাম, অবশ্যই বলুন। অতঃপর তিনি নিজের জিহ্বা ধরে বলেন, তুমি এটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা কি আমাদের কথার কারণে পাকড়াও হব? তিনি বললেন, হে মুয়াজ, জিহ্বার কর্মফল ছাড়া আর এমন কী জিনিস আছে যা মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে?’ (তিরমিজি: ২৬১৬)