নতুনত্বের ছাপ বলিউড অ্যাকশন সিনেমায়

১৮ আগস্ট, ২০২৪

ভারতীয় প্রযোজক গুনিত মংগা নির্মিত শর্ট ডকুমেন্টারি ‘দি এলিফেন্ট হুইস্পারারস’ অস্কার জয় করেছিল ২০২৩ সালে। তখন আলোচনায় এলেও তার সিনেমা যাত্রা কিন্তু বহু আগের। সাধারণত প্রযোজকরা বলিউডে যে ধারার সিনেমায় অর্থলগ্নি করতে চান তার চেয়ে ভিন্ন ধারায় ছিলেন তিনি শুরু থেকেই। তার প্রযোজিত সিনেমার তালিকা দেখলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়, যেমন- গ্যাংস অব ওয়াসিপুর, মাসান, জুবান, দ্য লাঞ্চবক্স ইত্যাদি। আগের সিনেমাগুলোয় কাহিনীর ব্যাপ্তি ছিল বড়, সেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব মনস্তাত্বিক গল্প বলা হয়েছে। গত ৫ জুলাই বিশ্বজুড়ে মুক্তি পেয়েছে গুনিত প্রযোজিত ‘কিল’।  

পরিচালক নিখিল নাগেশ ভাট ছাত্রজীবনে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন ট্রেনে। সে রকম এক ট্রেন যাত্রায়ই পাশের বগিতে ডাকাত পড়েছিল। অন্য আরেক বগিতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরা একদল সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন যারা ডাকাতির বিষয়টা টের পাননি। নিখিলের মাথায় তখন থেকেই প্রশ্ন ঘুরছিল, যদি সেনা সদস্যরা টের পেতেন কী ঘটছে, সেক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ কেমন হতো? এ প্রশ্ন থেকেই পর্দায় তিনি হাজির হলেন একটি গল্প নিয়ে। 

এক রাতের ট্রেন বা প্লেন যাত্রা নিয়ে পৃথিবীতে অনেক সিনেমা আছে। এ যাত্রা কোথাও প্রেম কাহিনীর অবতারণা করে আবার কোথাও নিয়ে আসে সাসপেন্স। কোথাও সঞ্চার করে ভয়ের। কিন্তু কিল প্রচলিত ধারা অনুসরণ করে না। প্লট এখানে একেবারেই লিনিয়ার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন অমৃত যখন জানতে পারেন তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা তুলিকার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তখন তিনি প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে হাজির হন। তারপর অমৃত তার বন্ধু ক্যাপ্টেন ভিরেশকে নিয়ে সে ট্রেনেই চড়ে বসেন। বিয়ে করার স্বপ্ন থেকে যখন দুই কপোত-কপোতী কীভাবে পরিবারকে রাজি করাবে তার প্ল্যান করতে ব্যস্ত, তখন প্রায় ৪০ সদস্যের একটা ডাকাত দল ট্রেনের মাঝামাঝি চারটি বগির শাটার ফেলে দিয়ে বগিগুলো দখল করে নেয়। মূল সিনেমা শুরু এখান থেকেই। 

খুবই সাদামাটা মনে হচ্ছে কিন্তু সিনেমার স্বাতন্ত্র্য অন্য জায়গায়। বইয়ের পাতায় একই দৃশ্য বা একই গল্প ভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলা যথেষ্ট কঠিন। তবে দর্শক ভাবছে তা হুবহু পর্দায় ফুটিয়ে তোলার সুযোগ আছে আজকের যুগে। প্রযুক্তি এখন এতই এগিয়ে যে জীবন্ত মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলার দৃশ্য দেখানোর জন্য সত্যি সত্যি কাউকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয় না। ডাকাতের হাত থেকে যাত্রীদের মুক্তি পাওয়ার গল্পও তাই আর দশটা থ্রিলার গল্প না হয়ে ফুটে উঠল পরিচালকের মুনশিয়ানায় ভয়াবহ রূপে। প্রথম ১৫-১৬ মিনিট পরে সিনেমায় যা শুরু হয় তা অনেকেই হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। 

ভায়োলেন্স ও রক্তারক্তির মিশেলে আতঙ্কিত, প্রতিশোধপরায়ণ, স্বাধীনতাকামী কিংবা দুর্দম মানুষের মনস্তত্ত্ব দেখানোর এ চেষ্টা অপ্রচলিত হলেও নতুন নয়। কিছুদিন আগেই ‘মাংকি ম্যান’ মুক্তি পেয়েছে নেটফ্লিক্সে, অভিনেতা দেব প্যাটেলের পরিচালনায়। সিনেমাটিতে দুর্নীতি, বৈষম্য, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, বর্ণপ্রথা, দারিদ্র্য ও ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতাসহ সামাজিক কিছু সমস্যার থিম নিয়ে একজন আন্ডারগ্রাউন্ড বক্সারের জীবন দেখানো হয়েছে। সেখানে আছে ভায়োলেন্স। জন উইকের কথাও দর্শকের জানা।

কিল সিনেমার ডাকাত দল নিয়েও কিছু ভাবনার জায়গা আছে। বেনি এবং তার বংশের মূল পেশা ডাকাতি। বেনির ছেলে ফানি, শালা, ভাই, ভাগ্নে, ভাইপো আর তাদের সন্তানরা মিলে ডাকাত দল। তারা ডাকাতিকে আর দশটা পেশার মতোই ভাবে। বেনি তার পেশায় সীমা অতিক্রম না করে নিজস্ব নীতি অনুসরণের চেষ্টা করে। অযথা খুন, লোভ, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ ইত্যাদি সে এড়িয়ে চলতে চায়। ডাকাতের মনস্তত্ত্বে ডাকাতি স্বাভাবিক পেশা হিসেবে প্রতীয়মান, কিন্তু অযথা খুনোখুনি সে করতে চায় না। এদিকে তার জেদি ও সাইকোটিক ছেলে ফানি যখন গল্পের নায়িকা তুলিকাকে খুন করে ও তুলিকার বোনকে ধরে রেখে মুক্তিপণ দাবির প্ল্যান করে তখনই ক্যাপ্টেন অমৃত তাদের পথ আটকে বসে। 

জেদি বা সাইকোটিক হলেও ফানি কাহিনীর সবচেয়ে চিন্তাশীল চরিত্র। আবার সে আবেগ নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। একটা সংলাপ আছে তার। ডাকাতির একপর্যায়ে বলে, এত নীতি-নৈতিকতার আলাপ করার কিছু নাই বাবা, তুমি ডাকাতি করতে আসছ, পূজা-অর্চনা না।

ফানি চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন রাঘব। তিনি ‘ড্যান্স ইন্ডিয়া ড্যান্স প্রোগ্রাম’ থেকে উঠে এসেছেন। কিল তার অভিনেতা সত্তাটাও ফুটিয়ে তুলেছেন ভয়াবহতার আদলে। অমৃত আর ভিরেশ চরিত্রে লক্ষ্য ও অভিষেক চৌহানও সুন্দর কাজ করেছেন। নবাগত লক্ষ্য ইন্ডিয়ান সিনেমার নতুন অ্যাকশন হিরো হিসেবে সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। তবে তুলিকা চরিত্রে তানিয়া আরো ভালো করতে পারতেন সম্ভবত। স্ক্রিনটাইম কম হলেও তানিয়ার চরিত্রের পরিণতিকে কেন্দ্র করেই গল্পের ভাগ্য এগিয়েছে, তার কাছ থেকে আরো ভালো পারফরম্যান্স আদায় করতে পারতেন নিখিল ভাট। 

তবে অভিনয় নয়, সিনেমাটির মূল সাসপেন্স কীভাবে অমৃত ডাকাতদের হারাবে তাতে। বেশির ভাগ সিনেমায় নায়কের পদক্ষেপ, ন্যায়-অন্যায় বোধ উত্তম রূপে প্রদর্শন করা হয়, শুভ-অশুভর লড়াইয়ে জয় আসে ন্যায় ও মহত্ত্ব থেকেই।