মৃতের পরিবারের জন্য যা যা করতেন নবীজি

২৬ আগস্ট, ২০২৪

প্রিয়জন হারানো মানুষের সবচেয়ে বেশি দরকার একটু আশা ও সান্ত্বনার বাণী। প্রিয়নবী (স.) প্রথমেই তাদের সান্ত্বনা দিতেন, ধৈর্যধারণে উৎসাহিত করতেন। এরপর যতটুকু সম্ভব সেবা করতেন। শোকার্ত পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। সাহাবিদেরও সে শিক্ষা দিতেন প্রিয়নবীজি। 

রাসুলুল্লাহ (স.) বলতেন, ‘তোমাদের কারো ওপর বিপদ এলে সে যদি বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন; আল্লাহুম্মা আজুরনি ফি মুসিবাতি ওয়াখলিফলি খাইরাম-মিনহা। (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা নিশ্চয়ই তাঁর কাছে ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে আমার বিপদের উত্তম প্রতিফল দান করুন এবং বিপদকে আমার জন্য কল্যাণে পরিবর্তন করে দিন) আল্লাহ তার বিপদকে কল্যাণে পরিবর্তন করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২১৬৬)

প্রিয়নবীজি শোকার্ত পরিবার-পরিজনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতেন, যেন তারা মৃত্যুশোকের কারণে অভুক্ত না থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন জাফর (রা.)-এর মৃত্যুর খবর এলো মহানবী (স.) বললেন, ‘জাফরের পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করো। কেননা তাদের কাছে এমন দুঃসংবাদ এসেছে, যা তাদের ব্যস্ত করে রাখবে।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩১৩২) জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মৃতের বাড়িতে সমবেত হওয়া ও খাদ্য প্রস্তুত করে পাঠানোকে আমরা বিলাপের (শোক প্রকাশ) অন্তর্ভুক্ত মনে করতাম।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬১২)

মৃত ব্যক্তির পরিবারের কেউ শোকে অসংযত আচরণ করলেও তার সঙ্গে কোমল আচরণ করতেন নবীজি। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (উহুদ যুদ্ধে) আমার পিতা আবদুল্লাহ (রা.) শহিদ হলেন। আমি তাঁর মুখমণ্ডল থেকে কাপড় সরিয়ে কাঁদতে লাগলাম। লোকজন আমাকে নিষেধ করতে লাগল। কিন্তু নবী (স.) আমাকে নিষেধ করেননি। আমার ফুফি ফাতিমা (রা.)ও কাঁদতে লাগলেন। তখন নবী (স.) বললেন, ‘তুমি কাঁদো বা না-ই কাঁদো (উভয় সমান)। তোমরা তাকে তুলে নেওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তাঁদের ডানা দিয়ে ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।’ (সহিহ বুখারি: ১২৪৪)

জাবির ইবনে আতিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) আবদুল্লাহ বিন সাবিত (রা.)-এর শুশ্রূষার জন্য গিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকেও তাঁর কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে বললেন, ‘হে আবু রাবি! আমাদের সম্মুখে তোমার ওপর আল্লাহর হুকুম (মৃত্যু) বিজয়ী হতে যাচ্ছে।’ এ কথা শুনে কিছু মহিলা উচ্চৈঃস্বরে কান্না শুরু করলে ইবনে আতিক (রা.) তাদের শান্ত করাতে লাগলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘তাদের ছেড়ে দাও। যখন মৃত্যু হয়ে যাবে তখন কোনোই ক্রন্দনকারিণী ক্রন্দন করবে না।’ (সুনানে নাসায়ি: ১৮৪৬)

মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আপনজনরা তার পরকালীন মুক্তি নিয়ে চিন্তিত থাকে। তাই কেউ তার জন্য দোয়া করলে তাদের হৃদয় প্রশান্ত হয় এবং মৃত ব্যক্তিও তা দ্বারা উপকৃত হয়। মহানবী (স.) মৃতব্যক্তির জন্য দোয়া করতেন এবং অন্যদেরও দোয়া করতে বলতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়বে, নিষ্ঠার সঙ্গে দোয়া করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩২০১)

অপর বর্ণনায় এসেছে, নবী (স.) মৃতের দাফন শেষ করে সেখানে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সে যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে সে জন্য দোয়া করো। কেননা তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩২২১)

আপনজনের মৃত্যুতে নারীরা বেশি শোকাতুর হয়। বিশেষত যদি মৃত্যুটা সন্তানের হয়। মহানবী (স.) সন্তানহারা মাকে বিশেষ সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন- ‘তোমাদের মধ্যে যে নারী তিনটি সন্তান আগেই পাঠাবে (মারা যাবে), তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।’ তখন জনৈক নারী বলল, আর দুটি পাঠালে? তিনি বললেন, ‘দুটি পাঠালেও।’ (সহিহ বুখারি: ১০১) ‘এক নারী রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে তার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে এলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এর ব্যাপারে আশঙ্কা করছি। ইতিপূর্বে আরো তিনজন মৃত্যুবরণ করেছে। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘তুমি তো এক কঠিন প্রাচীর দ্বারা জাহান্নাম থেকে নিজেকে রক্ষা করেছ।’ (সুনানে নাসায়ি: ১৮৭৭)

ঋণ রেখে কেউ মারা গেলে মহানবী (সা.) কখনো নিজে তা পরিশোধের দায়িত্ব নিতেন আবার কখনো অন্যরাও মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে ঋণগ্রস্ত কোনো মৃত ব্যক্তিকে (জানাজার জন্য) আনা হলে, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, সে কি ঋণ পরিশোধ করার মতো অতিরিক্ত কিছু রেখে গেছে? যদি বলা হতো যে সে ঋণ পরিশোধ করার মতো সম্পদ রেখে গেছে, তাহলে তিনি তার জানাজা পড়াতেন। অন্যথায় তিনি মুসলিমদের বলতেন, তোমরা তোমাদের সাথির জানাজা পড়ো। তারপর আল্লাহ যখন তাঁকে অনেক বিজয় দান করলেন তখন তিনি বললেন, আমি মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠতর। কাজেই মুমিনদের কেউ ঋণ রেখে মারা গেলে, তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমারই। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যাবে, তা তার ওয়ারিশরা পাবে।’ (সহিহ বুখারি: ৫৩৭১)