সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। একটি বিশেষ গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এই টাকা পাচার করেছে। যার কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। এমন অবস্থায় আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষায় এখন পর্যন্ত বেশ কিছু ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য নতুন করে টাকা ছাপিয়ে নয়, বিকল্প ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তঃব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ নিতে পারবে ব্যাংক; যার গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, আমরা নতুন টাকা ছাপিয়ে আর কোনো ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেব না। কারণ আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে গেলে এখন ২ লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। এতে দেশের মুদ্রা বাজার, বিদেশি মুদ্রা বাজার, মূল্যস্ফীতিসহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এজন্য সংকটে থাকা ৮ ব্যাংকের প্রয়োজন অনুযায়ী আন্তঃব্যাংকের মাধ্যমে অর্থাৎ এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসেবে পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) দেবে। আশা করি এটা কাজে দেবে।

তিনি বলেন, আপাতত এসব ব্যাংক কোনো ধরনের ঋণ বিতরণ করবে না। শুধু আমানতকারীদের কিছু কিছু টাকা ফেরত দেবে। তবে এতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমরা আমানতকারীদের অধিকার সংরক্ষণ করব। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সময় দিতে হবে।

গভর্নর ড আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ থেকে আট ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। এতে এসব ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা সীমিত পরিসরে তারল্য সাপোর্ট দিতে চাই। সরকার আমানতকারীর কথা ভেবে তাদের পাশে দাঁড়াবে।

তিনি বলেন, এ ব্যাংকে সমস্যা বহুদিন ধরেই সমস্যায় ছিল। আমানতকারীরাও তা জানতেন। তারপরও বিভিন্ন লোভে আপনারা সেখানে টাকার রেখেছেন। এজন্য লুটপাট করতে সহজ হয়েছে। তবুও আমরা আমানতকারীর স্বার্থটা দেখব, যাতে তারা অর্থ ফিরে পান।

তিনি বলেন, আমরা আমানতকারীদের অনুরোধ করব আপনারা এক সঙ্গে টাকা উত্তোলন করবেন না। আপনাদের প্রয়োজন মতো টাকা উত্তোলন করুন। আমাদের কিছুটা সময় দেন। আশা করি, ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, এ ৭ থেকে ৮টি ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংকখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

গভর্নর বলেন, দেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। পাচারকারীর দেশের মধ্যে থাকা সম্পদ উদ্ধার করব। প্রথমে আমরা এ উদ্যোগটি নেব। পাশাপাশি বাইরের দেশের পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়েও সহায়তা চেয়েছি কয়েকটি দেশের কাছে। বাইরের টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে উচ্চ আশা করব না, তবে শক্তভাবেই আমরা ধরব।

তিনি বলেন, পাচারকারীরা মূলত দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে। এজন্য আমরা প্রাথমিকভাবে এসব দেশ থেকে টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেব। ইতোমধ্যে বিদেশি সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমরা তাদের সহায়তা নেব।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচারকারী একটি পরিবার ব্রিটেনে ৫০০ থেকে ৬০০ বাড়ি কিনেছেন বলে শুনেছি। সে বিষয়ে আমরা আরও বিস্তর কাজ করছি। এছাড়া যারা ব্যাংক লুট করেছে আমরা তাদের দেশে থাকা সম্পদ থেকে দায় শোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এরপর তাদের বিদেশি সম্পদে আমরা হাত দেব।

এদিকে ব্যাংক সংস্কারে ৩টি টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, দেশের ব্যাংক খাত অনেকটাই ভঙ্গুর। এটা ঠিক করতে আমাদের ব্যাপকভাবে কয়েক বছর পর্যন্ত কাজ করতে হবে। এর সীমা ১-২টি ব্যাংকে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা সবগুলো ব্যাংককেই দেখব এবং কাজ করব। এজন্য একটি টাস্কফোর্স কাজ করবে। যেখানে আমাদের বাংলাদেশ থেকে কিছু অভিজ্ঞ লোক থাকবে। পাশাপাশি আমরা বিদেশ থেকেও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হায়ার করব। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

গভর্নর বলেন, আরেকটি টাস্কফোর্স বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করবে। আমরা যেভাবেই বলি ব্যাংক খাতের দুর্বলতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় দায় রয়েছে। ওই টাস্কফোর্স বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন, রাজনৈতিক চাপ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করবে। এককথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করতে কাজ করবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, তৃতীয় টাস্কফোর্স হবে অ্যাসেট উত্তোলনের জন্য। অর্থাৎ খারাপ সম্পদ রিকভারির জন্য দুদক, সিআইডি, বিএফআইইউ ও আদালতসহ সব বিষয় সমন্বয় করবে। এক্ষেত্রে সরকারের কিছু কিছু নীতি পরিবর্তন বা সহায়তার প্রয়োজন পড়বে।

এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হলো – ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এই ৮টি ব্যাংক এস আলমের দখলে ছিল । এর বাইরে ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।