খরচের লাগাম টানতে বাতিল হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটছাঁট হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি দায়িত্ব নিয়েই প্রকল্পে ব্যয় সংকোচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি বাস্তবায়নাধীন কম-প্রয়োজনীয় প্রকল্পও বন্ধ করার পক্ষে খোলাসা করেছেন নিজের অবস্থান।

আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন প্রকল্পকে তার দৃশ্যমান উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। এ জন্য তারা প্রকল্পগুলোতে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে আসছিল। অর্থনীতিবিদরা বারবার এসব প্রকল্পে গুরুত্ব কম দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাদের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও রয়েছেন।

দেড় দশকে অবকাঠামো উন্নয়নে কয়েক লাখ কোটি টাকা খরচ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। দৃশ্যমান হয় মেগা স্ট্রাকচার, সুবিধাও পাচ্ছে জনগণ। তবে বেশির ভাগ প্রকল্পে খরচের পরিমাণ নিয়ে ছিল প্রশ্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এশিয়া তো বটে, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল উন্নয়ন হয়েছে এ দেশে। এখন প্রদীপের নিচের অন্ধকার দিকটিতেও আলো ফেলতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) গুরুত্ব পাওয়া মেগাপ্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এটিতে রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণ আছে।

২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে মেট্রো রেল লাইন-৬ প্রকল্প। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ এক হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। মেট্রো রেল লাইন-১ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে এক হাজার ৯৪২ কোটি টাকা।

এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। মেট্রো রেল লাইন-৫ নর্দান রুট প্রকল্পে বরাদ্দ ৯৬৮ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর জন্য বরাদ্দ দুই হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে জাপানসহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে চীন। দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ এক হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় সাত হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে চীন ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ রয়েছে।

আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং সাসেক সংযোগ সড়ক প্রকল্প: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প।

অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে খরচের লাগাম টানতে শুরু করেছে সেই কর্মযজ্ঞ। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে টাকা খরচের ‘উৎসবে’ লাগাম টেনে ধরা শুরু করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ১৩টি প্রস্তাব। সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় এমনিতেই বেঁচে গেছে এমপিদের জন্য থোক বরাদ্দের প্রায় হাজার কোটি টাকা। ভাবা হচ্ছে- মেগা অবকাঠামোর বিকল্প অর্থায়ন নিয়েও। অর্থ সাশ্রয়ে যৌক্তিক কারণেই কাঁটছাঁট হতে পারে উন্নয়ন বাজেট।

জানা গেছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ফেরত পাঠানো প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে তিলমারী নদীবন্দর, মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন, কালুরঘাটে রেল ও সড়ক সেতু, রংপুর সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়ন ও ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ফোর লেন করতে ভূমি অধিগ্রহণ। ফেরত পাঠানোর পাশপাশি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী ডুয়েলগেজ রেলরুট এবং মেট্রোরেল লাইন ওয়ান ও ফাইভ প্রকল্পের খরচ।

অন্তর্বর্তী সরকার ছোট করতে যাচ্ছে জাতীয় বাজেটও। এতে কাটা পড়বে বিলাসী উন্নয়ন কল্পনার অনেক বরাদ্দ। ব্যয় সংকোচনের এই নীতি সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, পরিকল্পনা সংক্রান্ত ব্যয়, যানবাহন ও একইসঙ্গে যন্ত্র কেনাসহ নানা খাতের ব্যয় সংকোচন করতে হবে। প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখা হয় ইনভেস্টমেন্টের নাম করে। যেহেতু প্রকারন্তরে প্রকল্পের ব্যয়ের সাথে এটির খরচ দেখানো হয়। এগুলো রাখার প্রয়োজনীয়তাই নেই।

প্রকল্প অনুমোদনে প্রধান উপদেষ্টাকে চেয়ারপারসন করে এরই মধ্যে পুনর্গঠন হয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

প্রকল্প ব্যয় সংকোচন নিয়ে সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, নিজেদের নির্বাচনী এলাকার জন্য অসংখ্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এগুলোর অনেক কাজ এখনও চলমান। অনেকগুলো একনেকে যাওয়ার অপেক্ষায়। এগুলোর অগ্রাধিকার আছে কি না এবং কতটুকু সুবিধা বয়ে আনবে সেগুলো মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কম অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলো কাঁটছাঁট করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত ও অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ ঠিক করা হবে। মেগাপ্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা ও অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আমরা বৈঠক করব। এই সরকারের পলিসি অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম চলবে। কোনো প্রকল্প বাদ দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। উপদেষ্টা আমাদের যেভাবে কাজ করতে বলবেন আমরা সেভাবে করব