রাতে সূরা আল মুলক পাঠের গুরুত্ব ও ফজিলত

০৬ অক্টোবর, ২০২৪

সূরা আল মুলক পবিত্র কোরআনুল কারিমের ৬৭তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এর ২ রুকু, ৩০ আয়াত। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং সর্বশক্তিমান। তিনি মানুষকে দিয়েছেন দেখার ও শোনার শক্তি ও বিবেক। অথচ তারা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

সূরা আল মুলক পাঠের ফজিলত সীমাহীন। বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোরআনে এমন একটি সূরা আছে, যার আয়াত ৩০টি। এই সূরা যে পাঠ করবে, সেই ব্যক্তির জন্য সূরাটি সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সূরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলকু (সূরা আল মুলক)। (সুনানে আত-তিরমিজি, ২৮৯১)

প্রতি রাতের যেকোনো সময় সূরা মুলক তেলাওয়াত করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। তিরমিজি শরিফের ২,৮৯২ নম্বর হাদিস অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা আস-সাজদা ও সূরা আল মুলক তেলাওয়াত না করে কোনো দিন ঘুমাতেন না।

তার মানে এই নয় যে সূরাটি দিনে পড়া যাবে না। যেকোনো সময়ই পড়া যাবে, তবে রাতে বিশেষ আমল হিসেবে এ সূরা পড়া উত্তম। সূরাটি নামাজের সঙ্গে পড়াও ভালো। মুখস্থ না থাকলে দেখে দেখে অর্থ বুঝে পড়লে বিশেষ সওয়াব পাওয়া যায়।

সূরা আল মুলকের ৬টি ভাগ

প্রথম ভাগ ১ থেকে ৪ আয়াত—এ অংশে আছে আল্লাহর ক্ষমতার বর্ণনা।

দ্বিতীয় ভাগ ৫ থেকে ১৫ আয়াত—এ অংশে জাহান্নাম ও জান্নাতের প্রসঙ্গ।

তৃতীয় ভাগ ১৬ থেকে ২২ আয়াত—এখানে আছে অত্যাসন্ন বিপদের বার্তা।

চতুর্থ ভাগ ২৩ থেকে ২৪ আয়াত—সে বিপদে প্রস্তুতির সময় নিয়ে প্রশ্ন।

পঞ্চম ভাগ ২৫ থেকে ২৭ আয়াত—সে বিপদ কবে ঘটবে, তা নিয়ে মানুষের কৌতূহল?

শেষ ভাগ ২৮ থেকে ৩০ আয়াত—আল্লাহর বিপরীতে মানুষের দুর্বলতা।

সূরা আল মুলক এর বিষয়বস্তু

সূরাটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বজগতের কর্তৃত্ব ও রাজত্ব সবই আল্লাহর। আরো বলা হয়েছে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নিখুঁত।

সূরাটিতে আছে তারকারাজি সৃষ্টির রহস্যের কথা, কেয়ামতের দিন অবিশ্বাসীদের অবস্থা এবং তাদের চিন্তা ও গবেষণা করার দাওয়াত এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগানোর আহ্বান।

সূরাটির নামের মধ্যেই এর বিষয়বস্তু ও মর্মার্থ সুস্পষ্ট হয়েছে। আরবি মুলক মানে সার্বভৌমত্ব। আসমান ও জমিনে সার্বভৌমত্বের একমাত্র অধিকারী যে আল্লাহ, তা এ সূরায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সূরাটির শুরুতেই আল্লাহ তার পরম সার্বভৌম কর্তৃত্বের কথা ঘোষণা করেছেন।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’। এতে বোঝা যায়, জীবনের মতো মৃত্যুও স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি। এ আয়াত থেকে আরো স্পষ্ট বোঝা যায় যে যিনি মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, তিনি অবশ্যই মৃত্যু থেকে মুক্ত। অর্থাৎ মৃত্যু তার ওপর কার্যকর হতে পারে না।

৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি স্তরে স্তরে সাজিয়ে ৭ আসমান সৃষ্টি করেছেন। করুণাময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। আবার তাকিয়ে দেখো, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি না। তারপর তুমি বারবার তাকাও, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে’। এখানে আল্লাহ তার সৃষ্টিতে কোনো খুঁত বা অসংগতি আছে কি না, তা বারবার খুঁজে দেখতে বলেছেন। কারণ, প্রথমবার মানুষ যখন অবাক হয়ে কোনো কিছু দেখে, তখন কোনো ত্রুটি বা অসংগতি তার চোখে পড়ে না। বারবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহ সৃষ্টির অসংগতি খুঁজে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। নিটোল সৃষ্টির কোনো অসংগতি না দেখতে পেয়ে মানুষের দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।

এরপর পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি নিম্নতম আকাশকে প্রদীপমালায় সুশোভিত করেছি এবং তাদের ক্ষেপণীয় বস্তু করেছি শয়তানের ওপর নিক্ষেপ করার জন্য। আর আমি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি’। এ আসমানকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়েছে, তেমনি এগুলোকে আক্রমণের মাধ্যমও করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর এই সৃষ্টির মধ্যে কোমলতা ও কঠোরতা পাশাপাশি রয়েছে।

১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন, অতএব তোমরা দিগদিগন্তে বিচরণ ও তার দেওয়া জীবনের উপকরণ থেকে আহার করো। পুনরুত্থানের পর তারই কাছে ফিরতে হবে।

১৬. তোমরা কি এ কথা ভেবে নিশ্চিন্ত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে নিয়ে হঠাৎ করে মাটিকে ধসিয়ে দেবেন না, আর তা থরথর করে কাঁপতে থাকবে না? ১৭. বা তোমরা কি নিশ্চিন্ত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদের ওপর কঙ্কর-ঝঞ্ঝা বইয়ে দেবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে কী কঠোর ছিল আমার সতর্কবাণী। ১৮. ওদের আগে যারা এসেছিল তারা মিথ্যা আরোপ করেছিল, তাই কী কঠিন হয়েছিল ওদের ওপর আমার শাস্তি!

১৯. ওরা কি ওদের ওপরে উড়ন্ত পাখিদের লক্ষ করে না, যারা পাখা মেলে ও বন্ধ করে? করুণাময় আল্লাহই তাদেরকে স্থির রাখেন। তিনি তো সব বিষয়ই ভালো করে দেখেন।

২০. করুণাময় আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কি কোনো সেনাবাহিনী আছে যারা তোমাদেরকে সাহায্য করবে? অবিশ্বাসীরা তো বিভ্রান্তিতে রয়েছে। ২১. তিনি যদি জীবনের উপকরণ সরবরাহ বন্ধ ক'রে দেন, তবে এমন কে আছে যে তোমাদেরকে তা দেবে? ওরা তো অবাধ্যতা ও সত্যবিমুখতায় অটল রয়েছে। ২২. যে-ব্যক্তি মুখে ভর দিয়ে চলে সে কি ঠিক পথে চলে, নাকি সে-ব্যক্তি যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে?

২৩. বলো, ‘তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন আর তোমাদেরকে দিয়েছেন দেখার ও শোনার শক্তি এবং অন্তঃকরণ’। অথচ তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। ২৪. বলো, ‘তিনিই পৃথিবীতে তোমাদের বংশবিস্তার করেন আর তারই কাছে তোমরা সমবেত হবে’।

২৫. ওরা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে বলো এ-প্রতিশ্রুতি কবে পালন করা হবে’? ২৬. বলো, ‘এর জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে, আমি তো স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র’।

২৭. যখন শাস্তি আসন্ন দেখবে তখন অবিশ্বাসীদের মুখ ম্লান হয়ে পড়বে আর ওদেরকে বলা হবে, ‘এ-ই তো তোমরা চেয়েছিলে’।

২৮. বলো, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করেন বা আমাদের প্রতি দয়া করেন (তাতে ওদের কী), কে ওদেরকে মারাত্মক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে’? ২৯. বলো, ‘তিনি করুণাময়, আমরা তার ওপর বিশ্বাস রাখি ও তারই ওপর নির্ভর করি। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে’।

৩০. বলো, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি পানি মাটির নিচে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে কে তোমাদের জন্য পানি বইয়ে দেবে’?

(সূরা আল মুলক , কোরানশরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন)