'স্টোরিটেলারস অফ বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমে একদিন'

'স্টোরিটেলারস অফ বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমে একদিন'

বৃদ্ধাশ্রমে 'স্টোরিটেলারস অব বাংলাদেশ' এর সদস্যরা-

রুদ্র ইকবাল- 

বৃদ্ধাশ্রম! এক শব্দের শব্দটা বহন করে বহু দীর্ঘশ্বাস এবং বেদনার গল্প, খুব কাছের ব্যক্তিদের জীবিত থেকেও হারানোর গল্প। ইচ্ছে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। একটা সময় গিয়ে সবার ইচ্ছে থাকে তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কাটানোর, গল্প-গুজব করার। লোক মুখে শোনা : বৃদ্ধরা শিশুদের মত। সন্তানদের শিশু কাল থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করানো কারিগর বাবা-মায়েরা একটা সময় গিয়ে শিশু হয়ে যায়। ছোয়া পেতে চায় আপনজনদের, সংস্পর্শ পেতে চায়, শুশ্রূষা পেতে চায় প্রিয় মানুষদের। একটা তৃষ্ণা জন্মে নিজের সন্তান-সন্ততিদের সাহচর্য পাওয়ার। বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মায়েরা পুরোপুরি বঞ্চিত। নানা অজুহাতে ছেলেমেয়েরা রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। 

'স্টোরিটেলারস অব বাংলাদেশ' একটি উঠতি সংগঠন। মূলত বাংলাদেশের অসহায়, দরিদ্র এবং কষ্টকে সাথে নিয়ে লড়াই করে বাস করা ব্যক্তিদের জীবনের গল্প তোলে ধরার লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে ধারণ করে এই সংগঠনের পথচলা। সমাজের নিগৃহীত মানুষের গল্প তুলে এনে মানুষের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা মানবিক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই নিমিত্তে বৃদ্ধাশ্রম, অনাথাশ্রম, এতিমখানা ও ফুটপাতে শুয়ে থাকা পরিচয়হীন মানুষকে উপহারসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি তাদের গল্পসমূহ সবার সামনে তুলে এনে একটি মানবিক সমাজ বিনির্মানে এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করে যাচ্ছে। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মাহাদী হাসান এবং একঝাঁক মানবহিতৈষী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় এই সংগঠন গঠিত।

এপ্রিলের ৩০ তারিখ, ২০২১। তৈরি হচ্ছে একঝাঁক মানবহিতৈষী ব্যক্তি। আনন্দ, মানবিকতা এবং ভালবাসার টানে একত্রিত হওয়া সবার, এইতো একটু পর ছুটে যাবে বৃদ্ধাশ্রমে। এই স্বেচ্ছাসেবী টিমে আছে বিভিন্ন পেশার মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, স্কুল টিচার এবং কয়েকজন মা, সাথে তাদের ছোট ছোট সন্তান। কেউ কেউ তাদের আদরের সন্তানদের সাথে নিয়েছিলেন। যাতে করে সন্তানেরা বৃদ্ধাশ্রমের করুণ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। একরাশ আনন্দ এবং ভালবাসার টানে ছুটে চলা। বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মা'দের সময় দিতে পারবে এই অনুভূতি এবং ভাবনা সবাইকে ব্যাকুল করে তুলছে। গাড়িতে উঠে বসল সবাই, গন্তব্য গাজীপুরের কাপাসিয়ায় অবস্থিত আব্দুল আলী সেবাশ্রম নামে এক বৃদ্ধাশ্রম। 

সাথে রয়েছে কিছু উপহারসামগ্রী। স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেদের টিউশনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ এবং অনেক ব্যক্তির ডোনেশনের টাকা দিয়ে উপহার সামগ্রী কিনে নেয় বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় বাবা-মায়ের জন্য। উপহার সামগ্রী হিসেবে প্রত্যেকের জন্য শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, টাওয়াল, জুতো এবং নিত্য প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার যেমন দুধ, চা, চিনি, সুগার ফ্রি সুইটেনার, এবং কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ। 

অবশেষে গন্তব্য। বেশ কিছু বৃদ্ধ এগিয়ে আসল। হয়তো পথের দিকে চেয়ে থাকে তারা, কারো সন্তান আসছে কিনা! বেশ অবাকই হল, তাদের কারো সন্তান না, ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ব্যক্তি। সাথে উপহার সামগ্রী। প্রথমে আলাপ। পরবর্তীতে গড়ে উঠে এক সম্পর্ক, হয়তো অভিধান এই সম্পর্কের পরিভাষা আবিষ্কার করতে পারবে না। গল্প-গুজবে ভেসে উঠল নিজেদের কোলে পিঠে গড়ে তোলে সন্তানদের রেখে যাওয়ার গল্প, অশ্রুসিক্ত না হয়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ দেয় না এই গল্প গুলো। এক সময়ের জাদরেল মানুষ গুলো এখন সাহচার্য খোঁজে। নাতি-নাতনির মুখ দেখা এবং তাদের সাথে সময় কাটানো যেন সময়ের পরিক্রমায় অসাধ্য হয়ে উঠছে। এই গল্প গুলো স্বেচ্ছাসেবীদের চোখ গুলো ভিজিয়ে তুললো। এক ব্যক্তি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, নচিকেতা'ই আমাদের দুঃখ বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন, সন্তানদের মস্ত ফ্ল্যাটে একমাত্র কম দামী জিনিস মা-বাবা। পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, বাবারে! কোনদিন মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিও না। সারাটা দিন গেল তাদের সাহচর্যে। ইফতারের সময় হল, ইফতার হলো, হয়তো এই বাবা-মা'দের ইচ্ছে ছিল সন্তানদের সাথে এভাবে ইফতার করবে। অতীতে ফিরে গেল বেশ কয়েকজন, হয়তো বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলল 'যেদিন গেলো তা একেবারেই গেল বলে'। হটাৎ এক বৃদ্ধ বলে উঠল, 'ইফতার শেষে পান চিবাতুম, এক পন্ডিত নাতি ছিল তার লগে গাল-গল্প করতুম।' কথাগুলো নিস্তব্ধতা নামিয়ে আনল পুরো পরিবেশে। বেশ অনেক্ষণ এভাবে চলল, সময় হয়ে এলো বিদায়ের। স্বেচ্ছাসেবী এবং বৃদ্ধাশ্রমের সবার সম্পর্ক যেন বাবা-মায়ের মতো হয়ে গেল। বাবা-মায়েরা তো কখনো তার সন্তানকে যাওয়ার সময় না খেয়ে যেতে দিতে পারে না, তাদের অনুরোধ রাতের খাবার হল একসাথে। 

অশ্রুসিক্ত বিদায়। বৃদ্ধ বাবা-মা এবং স্বেচ্ছাসেবীরা সবার চোখ যেন চলচল করে উঠে। ফিনফিনে নিরবতা! সবাই গাড়িতে চেপে বসল, তবে মনটা যে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় পড়ে রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা প্রতিজ্ঞা করল, কখনো বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে না।

'মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের সবচেয়ে যে বড় গুণ, সেটি হচ্ছে মানবিকতা। আমাদের মানবিকতা আছেই বলে আমরা মানুষ। এই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা স্টোরিটেলারস অব বাংলাদেশ এর একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী গিয়েছিলাম গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা তে অবস্থিত একটি বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তাঁর দ্বিতীয় শৈশবে পদার্পণ করে। এ সময় একজন বৃদ্ধ সবচেয়ে যে জিনিসটি চায় সেটি হলো কারো সাহচার্য। সে দিক টি খেয়াল করেই আমরা সেই বৃদ্ধাশ্রমে সারাদিন কাটিয়েছি। তাঁদের আবেগ মাখা স্মৃতিচারণ শুনেছি। কেউ হয়তো তাঁর বেদনাসিক্ত বৃদ্ধাশ্রমে আসার গল্প বলতে গিয়ে অশ্রুশিক্ত হয়েছেন। শত কষ্টেও সেই চোখের কোণের অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি আমরাও। সন্তানের অবহেলার যন্ত্রণা যে কতটা বিষাক্ত তা তাঁদের চাহনিতেই স্পষ্ট হয়। আবেগাপ্লুত হয়েছি আমরাও।' স্টোরিটেলারস অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহাদী হাসান মুচকি হেসে কিছুটা বিষন্ন ভাবে কথা গুলো বলেন।

সংগঠনের সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী মেহেরিন, শরীফা, তাসনিম, নাশারাহ অংকুর, মিজু, মারুফ ও সাকিব তাদের ভাবনা তোলে ধরতে গিয়ে একমত হয়ে বলেন 'এভাবে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে পরিবার ছাড়া মানুষদের একটু মানসিক প্রশান্তি দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সবার উচিত এমন অবহেলিত মানুষের।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যায়।