এক রিকশাওয়ালা, লকডাউন এবং তার ঈদ

এক রিকশাওয়ালা, লকডাউন এবং তার ঈদ

খামটা খুইলা দেখল কিছু টাকা। এই টাকা দিয়ে সেমাই, কাপড় ভালভাবে কেনাকাটা করা যাবে-

রুদ্র ইকবাল-

বউ আর ইসলাম মিয়া ভাত চারটে খাইয়া সেহেরি করল। মাইয়্যা টাও উঠতে চাইছে, শ্যাষ রমজান। বউ'য়ে ডাকে নাই। শাক দিইয়া মাইয়া ভাত খাইয়্যা সারাদিন রোজা রাখব ক্যামনে! এই চিন্তা মা-বাপ দুজনের ছিল। মাইয়্যার ইচ্ছা ছিল- তিনটা রোজা রাখব- একটা পয়লা রোজা, পরেরটা শবে কদরের রোজা এবং শ্যাষ রোজা টা। ২ টা রাখলে ও শ্যাষ রোজা টা রাখা হয়নি।

ইসলাম মিয়া ঢাকায় রিকশা চালায়। বউ আছে, সাথে একটা মাইয়া ও আছে। ক' বছর বা হইব? ৫ কি ৬ বছর। তবে মাইয়া টা বেশ পাকা পাকা কথা কয়, মা'য়ে থামাইয়া দিবার চায়, ইসলাম মিয়া কই- কইতে দাও তারে। একটা বস্তিতে একটা বাসাভাড়া কইরা থাকে ইসলাম মিয়ার পরিবার। লকডাউনের আগ পর্যন্ত মোটামুটি একটা সুখী পরিবার ছিল।

সেহেরি শ্যাষ কইরা আগামীকালের চিন্তা কইরা শুয়ে আছে। ফজর আদায় করল। খোদার কাছে কইল, খোদা! মাইয়া আর বউ'ডারে কিচ্ছু লইবার দিতে পারি নাই গতবার ও পারি নাই। আমার লাইগা কিচ্ছু চাই না। এই ২ জনরে কিছু লইবার দিতে চাই তুমি ব্যবস্থা কইরা দিও মাবুদ। নামাজ শ্যাষ কইরা শুইয়া রইলো। ঘুম আইল। মাইয়্যার চেচামেচি তে ঘুম ভাঙল। মাইয়্যা কইতাছে- আমারে ডাকো নাই ক্যা? আমি তো মাত্তর তিনখান রোজা রাখবার চাইছি। ইসলাম ফিক কইরা হাইসা কইল- আগে বড় হও, তারপরে রাইখ্যো। মাইয়া ফোকলা দাঁতে হাইসা কইল আরে কত বড় হমু? মা'য়ে তো কই এখন বড় হইসি, বিয়া দিওন লাগব। আমার মা'য়েরে বিয়া দিমু না। কইতে কইতে রিকশা লইয়া বাইর হইয়া পড়ল ইসলাম মিয়া।

লকডাউন! ইসলাম মিয়ার বুকের ভেতর টা কাইপা উঠে পুলিশ দ্যাখলে। নিজেরে আড়াল করতে চাই। একবার রিকশা ডারে ভাইংগা দিছে - তখন কি অবস্থা টাই না গেল ইসলাম মিয়া এবং ইসলাম মিয়ার পরিবারের উপর। বাড়ি রহিম মিয়ার পিঠে ও পড়ল কিন্তু তার আঘাত লাগে নাই। রিকশার প্যাডেলের উপর তাগো তিন জনের রিজিক। বউ আর মাইয়্যার লাইগা যে কয়টা ট্যাকা রাখছিল প্রথমবার রিকশা ঠিক করতে সব ট্যাক শ্যাষ। পুলিশ দেখলেই এসব কথা মনে পইড়া যায়। দ্যাশে নাকি করোনা ভাইরাস আইছে! আমগোর লাইগা করোনা হয়, আমগো পাশ দিইয়া যে, কার চাইলা যায় তাগো লাইগা কিচ্ছু অয় না। বিড়বিড় কইরা নিজেরে নিজে কইতাছে ইসলাম মিয়া। 

দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া আছে। যাত্রী নাই। পরে একজন আইল, শুরুতেই কইল- ঐ খালি যাবি? আওয়াজ মধুর মতো মনে হইল। রাজি হইল। যামু স্যার। আসেন। তই ২০ টা ট্যাকা বাড়াইয়া দিয়েন লকডাউন তো হের লাইগা। বাড়াইয়া দিবার পারমু না, যাইলে না নইলে নাই। ইসলাম মিয়া কইল স্যার উঠেন যামু। প্রথম ভাড়া। ইসলাম মিয়া কইল- স্যার আপনি কইরা। উত্তর পাইল - তুই তুকারি কইরা। যাক এসব আর নতুন কিছু না। ৫০ টা ট্যাকা বহুত কিছু। তবে একটু রোদ। ঘাম বেয়ে যাচ্ছে, ভিজে যাচ্ছে আধ-চেড়া শার্ট টা। যোহর পর্যন্ত এই একটাই ভাড়া। যোহর পইড়া একই দুয়া আবার করল। আছরের পর আরেকটা ভাড়া। তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে শরীরটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তবুও যাত্রী পাইলে 'যাইতাম না' বলা যাইব না। একটু পর মাগরিবের আজান। 

মুয়াজ্জিনের মাগরিবের আজান। রাস্তার মোড়ে আইসা- রিকশায় পেডেল মেরে রিকশাওয়ালা রিকশা থেকে নেমে দোকানের নিকট আইসা গড়গড় কইরা কয়েক গ্লাস পানি খাইল। বিড়বিড় কইরা কইতাছে, পোলার মা'য়ে এবং মাইয়্যা'ডায় আমার লাইগা পথ চাইয়্যা আছে। রহিম মিয়া (দোকানদার) তাত্তারি কিছু ইফতারি দাও, ট্যাকাটা একসাথে দিইয়া দিমু নে। দোকানদার কইল, এইভাবে বাকি দেওয়া যাইব না। রিকশাওয়ালা বিষন্ন ভাবে তাকাইয়া কইল, দাও না মিয়া! দিয়া দিমুনে ইফতার না কইরা বইসা আছে মাইয়্যা এবং পোলার মা'য়ে। রহিম মিয়া চাহনি দেইখা নিজেরে অমানুষ হিসেবে রাখতে পারে নাই। ইফতারি দিইয়া কইল- এই লও। রোজা ত শ্যাষ। ট্যাকাটা দিও আমার ও তো পোলা-মাইয়্যা আছে। ইসলাম মিয়া হাইসা কইল - দিমু। 'আল্লাহ তোমারে রহমত করুক' বইলা - ইফতারি নিইয়া বাড়ির দিকে রওনা দিল। মাইয়্যা আর বউ বইসা আছে। পানি দিইয়া ইফতার করছে। ইসলাম মিয়ার হাত থেইকা ইফতার নিইয়া বউ ইফতার মাখাইল, ৩ জনের ইফতার শ্যাষ।

মাইয়াটা হুট কইরা কইয়া ফেলল, বাপ ও বাপ এই ঈদেও কিচ্ছু লইয়া দিবা না? পরবার মতো এই ২ টা ফ্রক আছে। পুরান হইয়া গ্যাছে তো। ইসলাম মিয়া মাইয়্যারে জড়াইয়া ধইরা চোখের পানি ছাইড়া দিছে। কইল দেহি মা। বউ ডা বুঝে। তার চোখ ও চলচল। 

রহিম মিয়া মাগরিব নামাজে সেজদায় পইড়া আছে। আল্লাহর কাছে কিছু চাইতেছে না। অঝোরে কাদঁতেছে। কাল ঈদ। না সেমাই কিনছে না মাইয়্যা, বউ, নিজের লাইগা কিছু কিনছে। কিছুই না। লকডাউন যে সব শেষ কইরা দিল।

মাগরিবের পর আবার রিকশা লইয়া বাইর হইল, ভাবতেছে একবার মহাজনের নিকট যাইব। কিন্তু মন কইতাছে লাভ হইব না। ঘোর কাটল পেছনের এক ব্যক্তির ডাকে।
-মামা যাবেন?
-কই যাবেন? 
-সামনেই।
-উঠেন।
কিছুটা আশ্চর্য হলো। আপনি ডাক টা খুব কম ব্যক্তিই ডাকে। মুখে মাস্ক। গল্প জুড়িয়ে দিল পেছনের ব্যক্তিটা, ইসলাম মিয়া ও খুশি মনে গল্প করতেছে। গল্পে নিজের পরিবারের কাহিনী বলে ফেলল, কইল লকডাইন দিইয়া না মাইরা এমনে মাইরা ফালাইলে বহুত ভালা আছিল। তাই না স্যার?

লোকটা চুপ। ফিনফিনে নিরবতা। কিছুদূর যাওয়ার পর বলল, আমার কাছে টাকা নাই। ভাড়া দিতে পারব না। তবে এই খামটা নেন। ঠকবেন না। ইসলাম মিয়া কেমন জানি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে উঠল। খাম নিয়ে মাথা তোলে দেখতেই কেমন জানি একটা সুগন্ধ, নিরবতা। মানুষটাও নাই। খামটা খুইলা দেখল কিছু টাকা। এই টাকা দিয়ে সেমাই, কাপড় ভালভাবে কেনাকাটা করা যাবে। হটাৎ তার দুআ'র কথা স্মরণ হইল, শরীর টা হিম হয়ে গেল। শুকরিয়া আদায়ে মসজিদে ছুটে গেল.....

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।