তরুণ মনে প্রেরণা যোগায় নজরুল

তরুণ মনে প্রেরণা যোগায় নজরুল

শারীরিক মৃত্যু হলেও সাহিত্যকর্মে বাঙালীর হৃদয়ে অমর কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেম ও বিদ্রোহের সমন্বয়ে গড়া এক অন্যরকম কবিসত্তা। সাম্যের গান গাওয়া এক ভুবনজয়ী বীরপুরুষ। মানুষের প্রতি দরদভরা হৃদয় নিয়ে যিনি সুর তুলেছেন বাঁশরীতে। একইসাথে হাতে রণতুর্জ নিয়ে লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। শারীরিক মৃত্যু হলেও সাহিত্যকর্মে বাঙালীর হৃদয়ে অমর তিনি। 

নজরুল মানেই ঝাকড়া চুলের বাবরী দোলানো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা এক মহান পুরুষ। পরাধীন বাঙ্গালীকে শির উচু করা শিখিয়েছেন যিনি। দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের প্রতীকে পরিনত হয়েছে তার কবিসত্তা। আজ পৃথিবীর যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম সেখানেই অনুপ্রেরণা নজরুল। অত্যাচারীর সামনে মাথা নোয়ানোর আগমুহূর্তেই বাতাসে ভেসে আসে নজরুলের কণ্ঠ 'বল বীর, বল চির উন্নত মম শির।' 

বিংশ শতাব্দীর কবি হলেও আজও তরুণ মনে প্রেরণা যোগান নজরুল। নজরুল  মানেই ঘুম ভাঙানীয়া পাখি। যে প্রতি ভোরে ডেকে চলে 'ভোর হলো দোর খোল খুকুমণি উঠরে...।' নজরুল মানেই নতুন দিনের আগমনী বার্তাবাহক, যার সাথে হাজারো তরুণ প্রতিনিয়ত শপথ নেয় 'ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত, আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, আমরা টুটাব তিমির রাত, বাঁধার বিন্ধ্যা চল।'

কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কী ভাবছে তরুণ প্রজন্ম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুনজুরুল ইসলাম নাহিদ। 

 

  • নজরুল ছিলেন গণ মানুষের কবি

রায়হান বাদশা রিপন

রায়হান বাদশা রিপন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আসানসোলের দুখু মিয়ার দুঃখ ঘোচেনি কোন দিনও। জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবনে দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন প্রতিনিয়ত। তাই তো তিনি লিখেছেন, হে দারিদ্র, তুমি করেছো মোরে মহান। ক্ষণজন্মা এই সৃষ্টিশীল লেখকের জীবনের প্রতিটি ধাপ এক একটি গল্প।  ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে এই ধুমকেতুর জন্ম। জীবনকে নিয়েছেন তিনি তার মতো করে। মনটা ছিল বেশ সহজ সরল। কবি নজরুল ছিলেন গণ মানুষের কবি। তিনি ছিলেন একাধারে প্রেম ও দ্রোহের কবি। তার শক্তিশালী লেখা ও ছন্দের মাধ্যমে দেশবাসিকে জাগিয়েছেন। দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষন ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে লিখেছেন - মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত।

১৯৪২ সালে কবি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ২২ বছর লিখনীর জীবনীতে লিখেছেন প্রায় ৩ হাজার গান, গজল কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদি। কৈশোরের সিয়ারসোল স্কুলের বন্ধু শৈলান মুখোপাধ্যায় কবির স্মৃতি স্মরণে বলেন- নজরুল হাতের সুখে গড়ে, পায়ের সুখে নিজের সৃষ্টি ভাঙ্গা মানুষ। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতার সপ্ন দেখিয়েছেন জাতিকে। কবির জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি রইলো দোয়া ও ভালবাসা।

 

  • সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকবর্তিকা নজরুল

মেহবুবু মোহিনী

মেহবুবা মোহিনী, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সর্বজনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। যিনি বাংলা কাব্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাত। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে আজও  যেন এই বিদ্রোহী বীর কে সবার আগে স্মরণে আসে। বিশ্বের ধর্ম-জাত ভেদাভেদকে দুর করতে নজরুলের কলমই ছিল সদা সোচ্চার। 

বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার অসামঞ্জস্য দিকগুলো থেকে মুক্তি, জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত দূরীকরণে তথা বিশ্বের কল্যাণে নজরুলের যেন এক আলোকবর্তিকা। জাতির মুক্তি, কল্যাণ ও সাহিত্যের উন্নয়নে নজরুল চর্চা এবং গবেষণা  ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। নজরুল গবেষণা নতুন প্রজন্মের কাছে  সাহিত্য সংস্কৃতি তুলে ধরতে অনস্বীকার্য অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। সরকারকে এ ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। 

  • নজরুলের অমর সৃষ্টি সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে

আলী আরমান রকি

আলী আরমান রকি, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী।  এছাড়া পরবর্তী জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ছাড়াও নানা পেশায় কাজ করেছেন। ছোটবেলা থেকে তিনি কঠিন সংগ্রামের মধ্যে বড় হয়েছেন। দারিদ্যতার কারনে তিনি কখনো লেটো দলে গান গেয়ে বেড়িয়েছে, কখনো মসজিদের মোয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেছেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে নানা সংগ্রামের মধ্য বড় হলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। নাটক, উপন্যাস, গান,  গজল ইত্যাদি রচনা করলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর সাহিত্য কর্মের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কখনো বিদ্রোহী নজরুলকে, কখনো আমরা পাই প্রেমিক হিসেবে।

কবি নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে আমরা পাই বিদ্রোহের সুর। তিনি সকল অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, করেছেন প্রতিবাদ। চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের  দিকে তাকালে দেখি অন্যরকম এক কবিসত্ত্বা। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে কখনো তাঁর প্রিয়তমার প্রেমে পড়েছেন, কখনো পড়েছেন প্রকৃতির প্রেমে। নজরুল কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। যেখানেই অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে। নজরুলের অমর সৃষ্টিগুলো বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবদান পাঠক হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

  • অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তহাতে কলম ধরেছিলেন নজরুল

রওজা ইসলাম

রওজা ইসলাম, ল' এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বঙ্গালী কবি। তিনি বিংশ শতাব্দীর কবি হলেও তার সাহিত্যকর্ম তাকে বাচিয়ে রাখবে শতাব্দির পর শতাব্দি। দেশপ্রেম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি সর্বদায় অনুপ্রেরণার বাতিঘর। 

মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার, সামাজিক অনাচার, অবিচার এবং শোষনের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার  ছিলেন তিনি। তার কলম ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহী রূপ নিয়েছিল তা আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে মানুষের হৃদয়ে। সকল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে  বিদ্রোহের সুর তোলে তিনি তার কবিতা এবং বিভিন্ন  যুগান্তকারী বাণীর মাধ্যমে  মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে,  প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। যে দেশে এমন কবি থাকে দেশ কখনো হারতে পারেনা। ভেঙ্গে পড়তে পারেনা। নজরুলের চেতনা বুকে ধারণ করে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে যাবে সামনের দিকে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক, 

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।