করোনা সতর্কতায় ঈদ

করোনা সতর্কতায় ঈদ

করোনা সতর্কতায় ঈদ

 

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন

মহামারী করোনা এখন সারা বিশ্বের ত্রাস। গত শতাব্দীর ১৯১৮-১৯ সালের পর ২০২১ সালে এসে ধরিত্রীবাসী এক মহাদূর্যোগের কবলে। আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি এবং নিরীহ জনগণ এক মহাক্লান্তিকালে। এ রকম একটা দূর্যোগ মূহুর্তে দ্বারে সমাগত ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা। যে যার মত প্রস্তুতি নিচ্ছি কোরবানীর। তার পাশাপাশি জারি রাখতে হবে করোনা মহামারীর ছোবল থেকে বাচাঁর চেস্টা। সামাজিক দুরত্বে অবহেলা নয়: নিজের তথা আপনজনের শ্বাস-প্রশ্বাসও এখন যেন নিজেরই শত্রু।

 কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন করোনা মহামারীর সংক্রমণ ঘটে শ্বাস-প্রশ্বাস আর হাঁচি-কাঁশির মাধ্যমে। তাই আপনজনকে সংকুচ না করে বুঝাতেই হবে যে সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা উভয়ের জন্যই ভাল। 'করোনা ছড়ানোর ধরণ' দৈনন্দিন জীবনে আপনি যে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেন, আস্তে কিংবা জোরে কথা বলেন, রাগে, হাসি-ঠাট্রায়, বক্তৃতায়, কিংবা মনের সুখে গান গেয়ে ও হাচি-কাশি দিয়ে-ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় নাক-মুখ থেকে পানি-মিউকাস মেমব্রেন রস নিঃসৃত যে বাতাস বের করেন তাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন 'রেস্পিরেটরি পারটিকেল'। করোনা ভাইরাসের কোন হাত-পা নাই। আছে বাহন। এই রেস্পিরেটরি পার্টিকেলই এদের বাহন যার মাধ্যমে আপনার- আমার মধ্যে প্রতিনিয়ত করোনার সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।

যে রেস্পিরেটরি পার্টিকেলের কথা বললাম, তা সাধারণতঃ ১-২০০০ মাইক্রোমিটার সাইজের হয়ে থাকে। এক মাইক্রোমিটার= এক সেন্টিমিটারের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। 'রেস্পিরেটরি পারটিকেল' দুই রকমঃ একটি হলো, রেস্পিরেটরি আরোসল বা ড্রপলেট নিউক্লিয়াই এদের সাইজঃ ১-৫ মিক্রোমিটার। শীতকালে কথা বলার সময় বিশেষ করে রোদ্রালোকে খালি চোখেই আমরা অনায়াসে দেখতে পারি। অন্যটি হলো, 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট'। সাইজ খানিকটা বড়ঃ ৫-২,০০০ মাইক্রোমিটার। খালি চোখেই হাচি, কাশি, বক্তৃতা, গান ও জোরে কথা বলার সময়ে এই 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' আমরা অনায়াসে দেখতে পারি। উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় তৈরী রেস্পিরেটরি ড্রপলেট'গুলো বাতাসের সংস্পর্শে আসার পর তিন ভাগ হয়ে যায়।

একটা অংশ 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' আকারেই অনেকটা স্থীর বাতাসে.৩ সেকেন্ডের মধ্যে ৬ ফুট দুরত্বের মধ্যে মাটিতে পড়ে। আরেকটি অংশের 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' ভেংগে'রেস্পিরেটরি এরোসল'বা 'ড্রপলেট নিউক্লিয়াই' তে রূপ নেয়, বাতাসে প্রবাহ ভাল থাকলে অনেক দূর পর্যন্ত যায় এবং ডাইলিউট হয়ে সংক্রমণ সক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু বদ্ধ ঘর বা পরিবেশে স্থীর বাতাসে করোনা ভাইরাস ২-৩ ঘন্টা ভেসে বেড়াতে পারে এবং সংক্রমণ সক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়।

শেষ অংশটির 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' নিজের জামা কাপড়,চেয়ার টেবিলে পড়ে 'ফোমাইট' হিসেবে থেকে যায় এবং পরে অন্যদেরকে সহজেই করোনার শিকারে পরিনত করে।এখানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমরা ৯৯% ক্ষেত্রে সংক্রমিত হই 'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' ও ফোমাইটে স্পর্শ করা ইনফেকটেড হাত দিয়ে নাক মুখ ও চোখে স্পর্শ করার মাধ্যমে। মাত্র ১% ক্ষেত্রে সংক্রমণ ঘটে 'রেস্পিরেটরি এরোসল'এর মাধ্যমে যাকে বলে এয়ারবর্ণ (Airborne)সংক্রমণ। এখন এই করোনা ভাইরাসের দ্বারা আপনার সংক্রমণ হবে কি হবে না তা নির্ভর করে

১) ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা (infectivity) ও এর রোগগ্রস্থ (Pathogenicity) করার ক্ষমতার উপর

২) আপনার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা, বয়স ও কো-মরবিডিটির উপর।

৩) ভাইরাসের ইনফেক্সাস ডোজের উপর ৪) আপনি কতক্ষণ, কোন পরিবেশে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে ছিলেন তার উপর। ৫)ভাইরাসের উৎস ও আপনার সাথে দূরত্বের উপর।'রেস্পিরেটরি ড্রপলেট' বা 'এরোসল' কত বেগে মানুষের নাক-মুখ থেকে বের হয় এবং আপনি তার থেকে কত দূরে কতক্ষণ থাকলে ইনফেকটেড হবেন তার হিসাবও বিজ্ঞানীদের করা আছে।সাধারণ অবস্থায়, ১০০০ মাইক্রোমিটার সাইজের একটি রেস্পিরেটরি ড্রপলেট .৩ সেকেন্ডের মধ্যে, ১০০ মাইক্রোমিটার সাইজের ৩ সেকেন্ডের মধ্যে এবং ১০ মাইক্রোমিটার সাইজের ৫ মিনিটের মধ্যে ১ মিটার দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ে। এক মাইক্রোমিটার সাইজের 'রেস্পিরেটরি এরোসল' বা 'ড্রপলেট নিউক্লিয়াই' ৫০-৩০০ মিনিটের মধ্যে ১ মিটার কিংবা আরো দূরে গিয়ে মাটিতে পড়ে।বিজ্ঞানীরা আরো স্পষ্ট করে বলছেন অনেকটা স্থীর বাতাসে নরমাল শ্বাস-প্রশ্বাসে বাতাস বের হওয়ার গতিবেগ থাকে ১মিটার/ সেকেন্ড।কথাবার্তা বলার সময়ে ৫মিটার/ সেকেন্ড, জোরে কাশিতে ১০ মিটার/ সেকেন্ড বা 50-100 মাইল/ঘন্টা এবং জোরে হাঁচিতে ২০-৫০মিটার/ সেকেন্ড বা ২০০ মাইল/ঘন্টা।

নরমাল শ্বাস-প্রশ্বাসে একজন মানুষ ৫০-১০০টি 'রেস্পিরেটরি পারটিকেল' বের করে এবং ইনফেকটেড ব্যক্তি প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে ২০-৩০টি ভাইরাস বের করে। কথা-বার্তা বলার সময় নরমাল শ্বাস-প্রশ্বাসের চেয়ে ১০ গুন বেশী 'রেস্পিরেটরি পারটিকেল' বের হয়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, ৫০-১০০০ করোনা ভাইরাস ঢুকলেই ইনফেকশন হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।গবেষণায় দেখ গেছে, একটা জোরে হাঁচি-কাশিতে ৩০,০০০-৪০,০০০ পর্যন্ত রেস্পিরেটরি ড্রপলেট থাকতে পারে।

যারা সুপার স্প্রেডার মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত তাদের বড় একটা হাঁচিতে ২০ কোটি ভাইরাস বের হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।গেল মার্চ, ২০২১ তে এমেরিকার এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, ইনফেকটেড হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে ন্যাসোফ্যারিক্স যেখানে ২.৫-১৯ মাইক্রোমিটার সাইজের রেস্পিরেটরি ড্রপলেট আটকা পড়ে। এই ন্যাসোফ্যারিনক্স থাকে নাকের পিছনে, ভোকাল কর্ডের উপরে। তাদের গবেষণায় থ্রেসোল্ড ইনফেক্সাস ডোজ হলঃ ৩০০ ভাইরাস পারটিকেল।

 অথচ ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ এর ইনফেকক্সাস ডোজ হলঃ ১৯৫০-৩০০০ টি ভাইরাস। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যঃ একজন মাইল্ড উপসর্গযুক্ত বা উপসর্গহীন রোগী বদ্ধ ঘরে মাস্ক বিহীন ১০ মিনিট তিন ফুট কম দূরত্বের মধ্যে কথা বলাবলি করলে উপস্থিত সুস্থ্য ব্যক্তি ইনফেকটেড হয়ে যেতে পারে। কারণ অসুস্থ্য রোগী থেকে কথা বলার সময় ২০০ ভাইরাস এবং ৫০-৫০০ রেস্পিরেটরি ড্রপলেট প্রতি মিনিটে বের হতে পারে। বদ্ধ ঘরে অবস্থানকরী করোনা ভাইরাসের রোগীর পূর্বের হাচি থেকে একজন সুস্থ্য ব্যক্তি স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসেও ২-৩ মিনিটের মধ্য ১০০০ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। আর যদি করোনাক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি না দিয়