তাওবা : আলোর পথে যাত্রা

তাওবা : আলোর পথে যাত্রা

তাওবা : আলোর পথে যাত্রা

 

আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর কতককে কতকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। মর্যাদাপ্রাপ্ত অনন্য একটি সৃষ্টি হচ্ছে বনি আদম তথা মানুষ।পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘বাস্তবিকপক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৭০)

এক দিকে মানুষকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করা হয়েছে। অন্য দিকে তাদের মাঝে রয়েছে মানবীয় দুর্বলতা। মানুষের মাঝে যেমন ভালো কাজ করার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় তেমনি মন্দ কাজের প্রতিও তাদের প্রবণতা লক্ষণীয়। একই সাথে দ্বিমুখী দু’টি বস্তু নিজের মাঝে ধারণ করে মানুষ চলতে থাকে আমৃত্যু। মন্দ কাজের প্রতি দুর্বলতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষকে দুর্বলরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে’ (সূরা নিসা-২৮)।

মানবীয় দুর্বলতার শিকার হয়েই মূলত আমরা দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আর ঠিক তখনই মানবজাতির চিরশত্রু শয়তান আমাদেরকে গোনাহের প্রতি প্ররোচনা দিতে থাকে। নফস উপর্যুপরি আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহ্বান করতে থাকে। শয়তান ও নফসের এ সাঁড়াশি যৌথ আক্রমণে আমরা দুর্বল মানুষরা পরাভূত হয়ে যাই। এক সময় (নাউজুবিল্লাহ) স্রষ্টার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে পড়ি।

শয়তান মানুষকে কখনো দারিদ্র্যের ভয় দেখিয়ে গোনাহে লিপ্ত করে। আবার কখনো সরাসরি অশ্লীলতা-বেহায়াপনার দিকে আহ্বান করে। পক্ষান্তরে দয়াময় আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা ও আপন দয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আদরের সৃষ্টি দুর্বল মানুষের প্রতি তিনি মাগফিরাত তথা ক্ষমার হাতকে সম্প্রসারিত করে রাখেন তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত।ইরশাদ হয়েছে, ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ করে আর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’ (সূরা বাকারা-২৬৮)।

দুর্বল মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে সফলতার পথ থেকে ছিটকে যায়। অজানা অন্ধকার উপত্যকায় উদাসীন হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। দয়াময় আল্লাহ আবারো সেই উদাসীন পথহারা মানুষকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন। গোনাহ থেকে মুক্ত হয়ে সফলতার পথে পা বাড়ানোর দিকনির্দেশনা দেন। গোনাহের অন্ধকারাচ্ছন্ন উপত্যকা ছেড়ে আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ আলোকময় পথে যাত্রার নামই হচ্ছে তাওবা। যার শাব্দিক অর্থ ফিরে আসা। আঁধার থেকে আলোর দিকে অভিযাত্রা। তাওবার মাধ্যমে একজন মানুষ ব্যর্থতার অতল গহ্বর থেকে সফলতার রৌদ্রোজ্জ্বল রাজপথে উঠে আসে। এ কারণেই কুরআন মাজিদে তাওবাকে সফলতার উপায় বলে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারো’ (সূরা নূর-৩১)।

একজন মানুষ যখন গোনাহে লিপ্ত হয় তখন সাধারণত তার মাঝে এক নৈরাশ্য কাজ করে। হতাশা তাকে ছেয়ে ফেলে। এই সুযোগে শয়তান তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার রসদ জোগায়। অনেকে তখন নিরাশ হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা তখন সেই ব্যক্তিকে তার রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার নির্দেশনা দেন। তিনি সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন মর্মে সান্ত্বনার বাণী শুনান।
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার উপর সীমালঙ্ঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাপ ক্ষমা করেন। নিঃসন্দেহে তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা জুমার-৫৩)।

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমার এই অফুরন্ত ধারা অব্যাহত থাকে ব্যক্তির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। জীবন রবি পশ্চিম দিগন্তে অস্তমিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবার সুযোগ থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তাওবা কবুলের যে দায়িত্ব নিয়েছেন তা কেবল সেই সব লোকের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত কোনো গোনাহ করে ফেলে, তারপর জলদি তাওবা করে নেয়। সুতরাং আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত, প্রজ্ঞাময়।’

তাওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে। পরিশেষে তাদের কারো যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তাওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায় মারা যায়। এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা নিসা : ১৭-১৮)।

ইমাম আবু জাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ আন নাবাবি রহ: (জন্ম-৬৩১, মৃত্যু-৬৭৬ হিজরি) বলেন, উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাওবা কবুল হওয়ার শর্ত তিনটি- ১. গোনাহ সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা। ২. গোনাহের কারণে লজ্জিত হওয়া। ৩. ভবিষ্যতে গোনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা।

গোনাহের সম্পর্ক যদি কোনো ব্যক্তির সাথে হয়ে থাকে, যেমন- কাউকে কষ্ট দিলো, অন্যায়ভাবে কারো সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নিলো, তাহলে এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত তিনটি শর্তের পাশাপাশি আরো একটি শর্ত পূরণ করতে হবে। সেটি হচ্ছে- যাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ধনসম্পত্তিকে তার হকদারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে’ (রিয়াজুস সালিহীন, পৃষ্ঠা-১৪, দারুল হাদিস কায়রো মিসরের সংস্করণ)।একজন মানুষ যখন গোনাহের অন্ধকার থেকে তাওবার আলোকময় রাজপথে পদচারণা শুরু করে তখন আল্লাহ তায়ালা ভীষণ আনন্দিত হন। কতটুকু আনন্দিত হন তার খানিকটা বিবরণ হাদিস শরিফে পাওয়া যায়।

হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘একজন মানুষ যখন তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন, বিজন মরুভূমিতে খাবার পানীয়সহ যার বাহন হারিয়ে যায়। আর ওই ব্যক্তি নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। অতঃপর কোনো একটি গাছের নিচে এসে হতাশ লোকটি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে লোকটি দেখে তার বাহন তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি আনন্দের আতিশয্যে ভাষা হারিয়ে প্রলাপ বকতে বকতে বলে- ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার গোলাম। আমি তোমার প্রভু।’ খুশির আধিক্যে তার ভাষা এলোমেলো হয়ে যায়। একজন বান্দার তাওবায় আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি আনন্দিত হন’ (সহিহ বুখারি-১১/৬৩০৯, সহিহ মুসলিম-৪/২১০৫)।
রাত-দিন সবসময় আল্লাহ তার বান্দার জন্য ক্ষমার হাতকে সম্প্রসারিত করে রাখেন। প্রভুর মাগফিরাত মানুষকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে।

হজরত আবু মূসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস আশয়ারি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রাতের বেলায় নিজের ক্ষমার হাতকে সম্প্রসারিত করে রাখেন, যাতে দিনের বেলায় যারা গোনাহ করে ফেলেছে তারা যেন তাওবা করে নিতে পারে। এমনিভাবে দিনের বেলায়ও তিনি আপন মাগফিরাতের হাতকে বিস্তৃত করে রাখেন, যাতে রাতের গোনাহগাররা তাওবা করে তার দিকে ফিরে আসে। এই সুযোগ পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় তথা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে’ (সহিহ মুসলিম-৪/২১১৩, মুসনাদে আহমাদ-৪/৩৯৫)।একজন মানুষের মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবার দরজা খোলা থাকে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার তাওবা কবুল করে থাকেন, যতক্ষণ না ওই বান্দার মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়’ (জামে তিরমিজি-৫/৩৫৩৭, ইমাম তিরমিজি রহ: হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)।
তাই আসুন আমরা হৃদয়ের জানালা খুলে দিই। দয়াময় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিই। গোনাহের নোঙরা দুর্গন্ধযুক্ত ভূখণ্ড থেকে তাওবার পবিত্র সুগন্ধময় আলোকোজ্জ্বল প্রান্তরে যাত্রা করি। আঁধার থেকে আলোর দিকে ফিরে আসি।
তাওবার সুরভিত নয়নাভিরাম উদ্যানে আপনাকে স্বাগতম।

লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর।