দেশে অর্থকরী ফসল লাক্ষা চাষ কমছে কেন

দেশে অর্থকরী ফসল লাক্ষা চাষ কমছে কেন

দেশে অর্থকরী ফসল লাক্ষা চাষ কমছে কেন

বাংলাদেশে লাক্ষা সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল হলেও দাম না পাওয়াসহ নানা কারণে দিন দিন কমছে লাক্ষা চাষির সংখ্যা এবং সংকুচিত হয়ে আসছে চাষের আওতায় থাকা এলাকার সংখ্যা।

লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ মোঃ মোখলেসুর রহমান বলছেন লাক্ষা চাষ কমতে কমতে এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।"লাক্ষা আসলে সেভাবে আর নাই। কিছু কৃষক ধরে রেখেছেন কিন্তু দাম ঠিক মত পান না বলে তারাও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। তবে সম্প্রতি দাম কিছুটা বাড়ায় কেউ কেউ আবার আগ্রহী হয়ে উঠছে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মি. রহমান বলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেকগুলো জায়গায় এক সময় অনেক লাক্ষা চাষ হতো কিন্তু এখন এটি নাচোল উপজেলার কয়েকটি গ্রামে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।নাচোলের একজন লাক্ষা চাষি সাদিকুল ইসলাম বলছেন তিনিসহ কিছু চাষি এখনো চেষ্টা করছেন এবং তিনি নিজে বগুড়ায় চাঁচ তৈরির কারখানা এবং বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানিতে লাক্ষা সরবরাহ করছেন।

"মাঝে একেবারেই দাম ছিল না কিন্তু এখন আবার একটু বেড়েছে। তাই সামনে চাষের আওতা বাড়ানোর চিন্তা করছি।"তবে বাস্তবতা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জসহ বিরাট এলাকা জুড়ে একসময় যে লাক্ষা চাষ দেখা যেত, সেটি এখন আর দেখা যায় না।

লাক্ষা আসলে কী

লাক্ষা এক ধরণের ক্ষুদ্র পোকা। এ পোকার ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক প্রকার গ্রন্থি থেকে আঠালো রস নিঃসৃত হয়, যা ক্রমশ শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে।পোষক গাছের ডালের এই আবরণই লাক্ষা বা লাহা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ডালের ঐ শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে ও শোধিত করে তা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।

দু ধরনের লাক্ষা পোকা থেকে লাক্ষা উৎপাদন করা যায়। মূলত বড়ই, পলাশ, বাবলা এ ধরনের পোষক গাছ থেকে লাক্ষা উৎপাদন করা হয়।সাধারণত বছরে দু বার ফসল পরিপক্ব হয় বা কৃষকরা উৎপাদন করতে পারে।কৃষক সাদিকুল ইসলাম বলছেন বৈশাখ ও কার্তিক মাসে তারা চাষের প্রক্রিয়া শুরু করেন।

ডঃ মোখলেসুর রহমান ও কৃষক সাদিকুল ইসলামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পোকার জন্য নির্ধারিত সময়ে গাছ ছাঁটাই করেন কৃষকরা।এর নির্ধারিত সময় পর গাছের ডালে লাক্ষা পোকাসহ খণ্ড খণ্ড পোষক গাছের ডাল, ছাঁটাই হওয়া গাছের সাথে আটকে দেয়া হয়।

রোদ পেলে কয়েকদিনের মধ্যেই পোকা ডালে বসে যেতে পারে এবং এর প্রায় চার সপ্তাহ পর ডালগুলো সাদা তুলার মতো আবরণে ঢেকে যায়।পরে ঝাঁক বেধে পোকা বের হতে দেখা যায়।

মি. রহমান বলছেন পোকা ওখানেই থাকে। রস খায় আর শরীর থেকে রস বের করে। তার পুরো শরীর রসে আবৃত হয়। এরপর বাতাসের সংস্পর্শ পেলে শক্ত আবরণ তৈরি হয় এবং ওই প্রাকৃতিক আবরণের মধ্যেই পোকাটা থাকে।তিনি বলেন পোকার আকৃতি অনেকটা উকুনের মতো এবং এগুলা খুব ঘন ঘন হয়ে বসে।

"এক বর্গ সেমিতে অন্তত একশ পোকা থাকে। আবার একটা পোকা গড়ে চারশো ডিম দেয়। এক ফুট দৈর্ঘ্যের ডালে লাখ লাখ পোকা বের হবে। এখান থেকেই লক্ষ পোকা বা লাক্ষা নামকরণ হয়েছে। পরে আবরণ শক্ত হলে ডাল কেটে বা বাকল উঠিয়ে প্রসেস করে চাঁচ ও গালা তৈরি করা হয়," তিনি বলেন।

কিভাবে প্রসেস করেন কৃষকরা, দাম কেমন?

নাচোলের লাক্ষা চাষি সাদিকুল ইসলাম বলছেন গাছের ডালে লাক্ষা নি:সৃত রস শক্ত হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পর সেই বাকল অর্থাৎ কাঁচা লাক্ষা তুলে নেয়া হয়।

"পরে ভালো করে ধুয়ে এগুলো রোদে শুকাই। শুকিয়ে যাওয়ার পর এক ধরণের আঠা মিশিয়ে আগুনে তাপ দিতে হয় থান কাপড়ে মুড়িয়ে। তাপের কারণে ময়লা মাটিসহ অপ্রয়োজনীয় যা থাকে তা কাপড়ের সাথে থেকে যায় আর রয়ে যায় মূল ছাড়ানো লাক্ষা । কখনো দানা আকারে বা কখনো ছাড়ানো লাক্ষা টুকরো করে আমরা বাজারে বিক্রি করি।"

মোখলেসুর রহমান বলছেন এই ছাড়ানো লাক্ষা প্রক্রিয়াজাত করে চাঁচ, টিকিয়া ও গালা তৈরি করা হয় এবং প্রায় একশ কেজি ছাড়ানো লাক্ষা থেকে ৫০/৬০ কেজি চাঁচ বা গালা পাওয়া সম্ভব।সাদিকুল ইসলাম বলছেন তিনি বগুড়ায় একটি চাঁচ কারখানায় লাক্ষা সরবরাহ করেন।"প্রসেস করার আগে দিলে ৪/৫শ টাকা কেজি আর প্রসেস করে দিলে ১০০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত এখন কেজি দাম পাওয়া যাচ্ছে," বলছিলেন তিনি।

চাহিদা বাড়ছে কিন্তু উৎপাদন কমছে- কারণ কী?

ডঃ মোখলেসুর রহমান বলেন গত কয়েক বছরে আম চাষ অনেক বেড়ে গেছে আর তাল মিলিয়ে কমছে লাক্ষা চাষ এবং এর জন্য দায়ী আম চাষিদের অবৈজ্ঞানিক আচরণ।

"এখন আমবাগান অনেক বেশি। তারা সকাল বিকাল কীটনাশক স্প্রে করে। অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডোজ দেয়। এগুলো এভাবে স্প্রে করার কারণে আশে পাশের গাছেও লাক্ষা পোকা টিকতে পারে না।"তিনি বলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাচোলে আম চাষ কম হওয়ায় সেখানে লাক্ষা চাষ করছেন অনেকে।

এই বিজ্ঞানীর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার টন লাক্ষার দরকার হয় কিন্তু উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ দুশো টন।তিনি বলেন দেশে যে পরিমাণ বড়ই গাছ আছে তা পরিকল্পনা করে লাক্ষা চাষের আওতায় আনতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে স্বনির্ভর হয়ে বিদেশে রপ্তানিও করা সম্ভব।

কত কাজে ব্যবহার হয় লাক্ষা?

ডঃ মোখলেসুর রহমান বলছেন আসবাব পত্রের বার্নিশ ও স্বর্ণের ফাঁপা অংশ পূরণ সহ অন্তত একশ ধরনের কাজে লাক্ষা দরকার হয়।কৃষি প্রযুক্তি বিষয় একাধিক বইয়ে দেয়া তথ্য অনুযায়ী যেসব কাজে লাক্ষার চাহিদা বেশি তার মধ্যে রয়েছে:

১. কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ করা

২. স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ

৩. ঔষধের ক্যাপসুলের কোটিং

৪. চকলেট ও চুইংগামের কোটিং

৫. ডাকঘরের চিঠি বা পার্সেল সিলমোহরের কাজ

৬. লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষা বা লবণাক্ততায় নষ্ট হওয়া লৌহ ঠিক করার কাজে

৭. অস্ত্র ও রেল কারখানার কাজে

৮. পুতুল, খেলনা ও টিস্যু পেপার তৈরির কাজে।

সূত্র : বিবিসি