বার্ধক্য একটি 'রোগ', যা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব

বার্ধক্য একটি 'রোগ', যা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব

বার্ধক্য একটি 'রোগ', যা চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব

আমরা জানি বার্ধক্য ঠেকানো যায় না, বার্ধক্য একটা প্রাকৃতিক নিয়ম এবং প্রত্যেকেরই নিয়তি। আমরা বেশিরভাগ মানুষ জীবনকে এভাবেই দেখি। কিন্তু জেনেটিক বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার তা মনে করেন না।

দুই দশকের ওপর এ বিষয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। তিনি বলছেন যে বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব - দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন শুধু কিছু সহজ অভ্যাস।ড. সিনক্লেয়ার বিশ্বাস করেন, এমন দিন খুব দূরে নেই যখন ওষুধের সাহায্যে বার্ধক্য সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এসব ওষুধ এখন পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে এবং এই ওষুধগুলো দিয়ে বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া আসলেই আটকে রাখা যাবে বলে তিনি বলছেন।

কে এই বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার?

বিজ্ঞানী ড. ডেভিড সিনক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন এবং পরবর্তীতে গবেষণা করেছেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একটি ল্যাবরেটোরির প্রধান, যেখানে তার গবেষণার বিষয় - 'কেন আমরা বুড়ো হই'।তার গবেষণার জন্য তিনি বিজ্ঞান জগতের বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি একজন সেলিব্রিটিও। টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০জনের তালিকায় তিনি নির্বাচিত একজন ব্যক্তিত্ব এবং টুইটারে তার অনুসারীর সংখ্যা দুই লাখ।

তার ৩৫টি গবেষণার সত্ত্বাধিকারী তিনি নিজে। তিনি বেশ কয়েকটি জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের হয় প্রতিষ্ঠাতা, নয়তো সেগুলোর কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটি কাজের ক্ষেত্র হল বার্ধক্য বিলম্বিত করা বা ঠেকানো।মেরিল লিঞ্চ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বার্ধক্য সংক্রান্ত কাজে বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২৫ সালে গিয়ে পৌঁছবে ৬০ হাজার কোটি বা ৬০০ বিলিয়ন ডলারে।

বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি কাটতি যে বইটির, সেটি ড. সিনক্লেয়ারের লেখা - 'লাইফস্প্যান-হোয়াই উই এজ-অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু' (কেন আমরা বৃদ্ধ হই-আর কেন আমরা বৃদ্ধ হবো না)।এই বইয়ে তিনি প্রচলিত বিশ্বাস ভাঙার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন - কেন বার্ধক্য একটা অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া নয়।

ড. সিনক্লেয়ার বিশ্বাস করেন বৃদ্ধ হওয়া নিয়ে যেভাবে আমরা ভাবি, সে ভাবনাতে আমাদের আমূল পরিবর্তন করতে হবে: আমাদের ভাবতে হবে বার্ধক্য একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, আমাদের এটাকে একটা 'অসুখ' হিসাবে দেখতে হবে - অর্থাৎ রোগ হিসাবে এর চিকিৎসা সম্ভব এবং এর নিরাময়ও সম্ভব।

তিনি বলছেন, বৃদ্ধ বয়স নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা একেবারে পাল্টে ফেলতে পারি, তাহলে মানবজাতির আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব হবে।

অন্যথায়, তিনি বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হয়েছে তার ফলে আমাদের আয়ু আরও বছর দু'য়েক হয়ত বাড়ানো যাবে: "আমাদের লক্ষ্য সেটা আরও অনেক বাড়ানো।"বিবিসি ব্রাজিলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. সিনক্লেয়ার যা বলেছেন নিচে তার সারাংশ দেয়া হল:

আমরা বৃদ্ধ হই কেন?

ড. সিনক্লেয়ার: বুড়ো হওয়ার নয়টি প্রধান কারণ চিহ্ণিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত ২৫ বছরে আমার চালানো গবেষণায় আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে এগুলোর মধ্যে একটি হল বৃদ্ধ হওয়ার পেছনে অন্য সবগুলো কারণ এর জন্য দায়ী, এবং এর ফলে শরীর তার সব তথ্য হারিয়ে ফেলে।

আমাদের শরীরের দুই ধরনের তথ্য মজুত থাকে - এর মধ্যে এক ধরনের তথ্য আমরা বংশগত ভাবে পাই আমাদের বাবামায়ের কাছ থেকে, আর অন্য ধরনের তথ্যগুলো শরীরে তৈরি হয় সময়ের সাথ সাথে পরিবেশগত নানা কারণে।

এর একটি হল "ডিজিটাল" তথ্য - অর্থাৎ যেগুলো জেনেটিক সূত্র এবং অন্যটি হল "অ্যানালগ" তথ্য - যাকে বলা হয় 'এপিজিনোম', যেটি কোষের ভেতরকার একটা পদ্ধতি, অর্থাৎ কোন জিন চালু রাখতে হবে, কোনটা বন্ধ করে দিতে হবে সেটা যে পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে।

একটা কোষের ভেতর যে ২০ হাজার জিন থাকে, সেগুলোর মধ্যে কোনটি সক্রিয় থাকবে, আর কোনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, সেটাই কোষটিকে বলে দেয় সে কে- অর্থাৎ ওই কোষের পরিচয় কী হবে এবং কীভাবে সেই কোষটি কাজ করবে।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই এপিজিনোম পদ্ধতি তথ্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে।

ধরুন ঠিক যেভাবে আপনার গানের একটা সিডিতে আঁচড় লেগে গেলে সিডি সেখান থেকে গানের অংশটা আর খুঁজে বের করতে পারে না। ফলে তথ্যের অভাবে কোষগুলোও ঠিক সময়ে সঠিক জিনকে চালু করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে - তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।আমার মতে, এ কারণেই আমরা বুড়ো হই।

কেন বলছেন আমাদের বৃদ্ধ হওয়ার যুক্তি নেই?

ড. সিনক্লেয়ার: কারণ জীব বিজ্ঞানে কোথাও লেখা নেই যে আমাদের বুড়ো হতে হবে। আমরা জানি না ঠিক কীভাবে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হয়। যদিও এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার বিষয়টা আমরা ক্রমশ শিখেছি।

আমাদের ল্যাবে আমরা বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি।আমার বক্তব্য, এই প্রক্রিয়া - যেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এপিজিনোম বলে - সেটা বদলানো সম্ভব।

যেটাকে আমি সিডিতে আঁচড় লাগার সাথে তুলনা করছি, সেটা আমাদের জীবনকে বিশালভাবে প্রভাবিত করে। আমরা কিছু জিনিস ঠিকভাবে করতে পারলে আমাদের বয়সের ঘড়িটায় জোরেসোরে রাশ টানা সম্ভব। আজকের দিনে এই ঘড়ির দমটা মাপাও যায় - রক্ত এবং থুতু পরীক্ষার মাধ্যমে।

আমরা ইঁদুর, এমনকি তিমি. হাতি আর মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছি একেকটা প্রাণীর জীবনযাত্রা একেক রকম - ফলে তাদের প্রত্যেকের বয়স বাড়ে ভিন্ন গতিতে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল, ভবিষ্যতে আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা কী হবে, তার ৮০ শতাংশের বেশি নির্ভর করে আপনার জীবনযাত্রার ওপর, আপনার ডিএনএ'র ওপর নয়।

যারা বহু দিন বাঁচেন, তাদের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। এখানে জীবনযাত্রার মধ্যে রয়েছে আপনি সঠিক খাবার খাচ্ছেন কিনা - যেমন ধরুন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মানুষ যে ধরনের খাবার খায়, সেটা খুবই ভাল। কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া, বারবার না খাওয়া। শারীরিক ব্যায়ামও সাহায্য করে।অনেকে আবার মনে করে বরফ বা ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করে শরীরের তাপমাত্রা কমানোও উপকারী।

বৃদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া দেরি করতে এগুলো কীভাবে সাহায্য করে?

ড. সিনক্লেয়ার: বিজ্ঞানীরা মনে করেন জীবনযাত্রার বিভিন্ন অভ্যাস এবং শরীর ভাল রাখতে অভ্যাসের যেসব পরিবর্তন আমরা করি, সেগুলো রোগব্যাধি এবং বার্ধক্যের বিরুদ্ধে শরীরের একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।গরম বা ঠাণ্ডা বোধ, ক্ষুধা বোধ, দমের অভাব - এসব অনুভূতি শরীরের এই প্রতিরোধী প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে।

এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূলে রয়েছে মাত্র গুটিকয় জিন। আমরা এগুলোর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছি। এই জিনগুলো এপিজিনোমকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষুধা এবং ব্যায়াম এগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। এ কারণেই আমরা মনে করি, সঠিক খাবার খাওয়াা এবং উপোষ করা বয়সের ঘড়িকে ধীরে চলতে সাহায্য করতে পারে।বার্ধক্য বেশিরভাগ রোগের কারণ। হৃদরোগ, স্মৃতিভ্রম এবং ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ বার্ধক্য।কাজেই বার্ধক্য ঠেকাতে পারলে অনেক রোগ ঠেকানো সম্ভব, শরীরে জোর আনা এবং দীর্ঘায়ু হওয়া সম্ভব।

নেচার নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা অবশ্যই বৃদ্ধ হয়। সেটা কি আপনার গবেষণার উল্টো নয়? ওই গবেষণা অনুযায়ী বার্ধক্য তো ঠেকানো বা বিলম্ব করা সম্ভব নয়?

ড. সিনক্লেয়ার: দুশো' বছর আগে একজন মানুষ সবচেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করতে পারতো একটা ঘোড়া যত জোরে ছুটতে পারে সেই গতিতে।এখন নতুন প্রযুক্তি অনেক কিছু বদলে দিচ্ছে। এমনকি জীব বিজ্ঞানও বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। প্রযুক্তি অনেক সমস্যার সমাধান করছে, অনেক উন্নতি আনছে।

মানবজাতির সৃষ্টির ক্ষমতা তাকে উন্নত জীবন দিয়েছে। প্রযুক্তি ছাড়া আমরা বাঁচতাম না।বার্ধক্যকে জয় করতেও আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করব। সহস্রাধিক বছর ধরে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়েছি।

এটাই হবে পরের ধাপ - অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের সীমাবদ্ধতাকে আমরা অতিক্রম করব।আমরা প্রতিদিন কিন্তু এই কাজটা করি। আমরা শরীরে বদল আনতে ওষুধ খাই, আমরা পরিবেশ বদলাতে পদক্ষেপ নিই। একইভাবে আমরা শরীরের রসায়নও বদলাব।

কিন্তু আপনি বার্ধক্যের মোকাবেলায় ভিন্ন পথের কথা বলছেন: আপনি বলছেন বার্ধক্য একটা রোগ। কেন?

ড. সিনক্লেয়ার: রোগ কিন্তু দুম করে হয় না। এটা শরীরের ভেতর বাসা বাঁধে। ধীরে ধীরে তার উপসর্গ, লক্ষণ প্রকাশ পায়। মৃত্যুও আসে সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে। বুড়ো হবার প্রক্রিয়াটাও একই রকম।

বার্ধক্য একটা রোগ। এটা সবার হয়। কিন্তু যেহেতু এটা সবার হয় এবং আমরা মনে করি এটা প্রাকৃতিক নিয়ম, তার মানে এই নয় যে এটাকে মেনে নিতে হবে।আমরা প্রমাণ করছি যে এই রোগও সারানো যায়, এই রোগ ঠেকানো যায়, এই রোগের প্রকাশ বিলম্বিত করা যায়।

বর্তমানে যেহেতু বার্ধক্যকে আমরা রোগ হিসাবে দেখি না, তাই ডাক্তাররা বার্ধক্যের চিকিৎসা করার জন্য কোন ওষুধ দিতে দ্বিধা বোধ করেন। কিন্তু কিছু ওষুধ একজন মানুষকে বহু বছর সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।অতএব, বার্ধক্যকে অসুখ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে - অথবা অন্তত বলতে হবে যে, এটা চিকিৎসা করা যায় এমন একটা স্বাস্থ্য সমস্যা।

কিন্তু বুড়ো হওয়া বলতে আমরা যা বুঝি এটা তো তার থেকে অনেক আলাদা। বার্ধক্য আমরা মনে করি অবশ্যম্ভাবী একটা প্রক্রিয়া। আপনি বলছেন এর চিকিৎসা করা যায়, বুড়ো হওয়া দেরি করানো যায়, এমনকি বন্ধ করা যায়। একটু বিপ্লবী চিন্তাভাবনা নয় কি?

ড. সিনক্লেয়ার: বিপ্লবী বৈকি। কিন্তু বিমানে ওড়া, অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া, কম্পিউটার ব্যবহার করা - এগুলো কি বিপ্লবী ছিল না?মানবজাতি তো এভাবেই এগোয়।আমরা চাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন - আমরা চাই দীর্ঘ আয়ু। এমনকি আমরা যদি সব রোগ নিরাময়ের পথ আজ পেয়ে যাই- তাহলেও মানুষের আয়ু আমরা গড়ে মাত্র বছর দু'য়েকের বেশি বাড়াতে পারব। কিন্তু আমরা তো আরও অনেক বেশি চাই।

বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়া আপনারা ল্যাবরেটোরি পরীক্ষায় ঠেকিয়েছেন বলছেন? কীভাবে?

ড. সিনক্লেয়ার: এপিজিনোম প্রক্রিয়াকে কীভাবে মুছে ফেলা যায় আমরা সেটা উদ্ভাবনের কাজ করছি - অনেকটা সিডিতে লাগা আঁচড় পরিষ্কার করে ফেলার মত।

আমরা অনেক জিনের ওপর কাজ করেছি দেখার জন্য যে বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়া নিরাপদে আটকে দেয়া যায় কিনা।অনেক বছর এ কাজে আমরা সফল হইনি। এমনকি গবেষণাগারের এই কাজ করতে গিয়ে আমরা কোষের বদল ঘটিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করে ফেলেছি।

অবশেষে আমরা তিনটে জিনের সন্ধান পাই, যেগুলোকে বলে ইয়ামানাকা ফ্যাক্টরস। এই জিনগুলো কোষের পরিচয় বদলায় না, কিন্তু বুড়ো হওয়া আটকে দেয়।এই কাজ আমরা করি মানুষের ত্বকের কোষ এবং স্নায়ুর কোষে।এরপর আমরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালাই। ইঁদুরগুলোর চোখের স্নায়ু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমরা তাদের চোখের স্নায়ুতে প্রাণ ফিরিয়ে তাদের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার করেছি।

এটা কি ভবিষ্যতে মানুষের ওপর কাজ করবে?

ড. সিনক্লেয়ার: দেখুন, এমন মানুষ আছেন যারা এটা বিশ্বাস করেন এবং গবেষণায় অর্থ লগ্নী করতে চান। তাদের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে।তারা ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালাতে দু'বছরের জন্য অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আমরা মানুষের ওপর প্রথম ট্রায়াল শুরু করব। আমরা দেখব এই প্রক্রিয়ায় মানুষের অন্ধত্ব নিরাময় করা যায় কি-না।

বিজ্ঞান এ পর্যন্ত কী আবিষ্কার করতে পেরেছে আর বার্ধক্য ঠেকিয়ে রাখার যে ওষুধের কথা আপনি বলছেন তা নিয়ে কতটা কাজ হয়েছে?

ড. সিনক্লেয়ার: কিছু অণু আমরা খুঁজে বের করেছি - প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়, আবার রসায়নাগারে তৈরি করা যায়। দু'রকমই। এগুলো বুড়ো হবার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে এবং আয়ু বাড়াতে কাজ করবে এমন প্রতিশ্রুতি আমরা দেখতে পেয়েছি। প্রাণী দেহে এবং এমনকি মানুষের শরীরেও এগুলো কাজ করবে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।এর মধ্যে অন্তত দু'টি ওষুধ ইতোমধ্যেই বাজারে পাওয়া যায়।

এ ধরনের একটা ভাল ওষুধের উদাহরণ হল মেটফরমিন, যা টাইপ-টু ডায়বেটিস রোগীদের দেয়া হয়।ডায়বেটিস রোগী, যারা মেটফরমিন খাচ্ছেন, তারা ডায়বেটিস হয়নি এমন মানুষের চেয়ে বেশিদিন বাঁচছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। হাজার হাজার যেসব মানুষ মেটফরমিন খান তাদের ওপর চালানো গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ক্যান্সার, হৃদরোগ, আলঝাইমার এবং এই ওষুধের গুণাগুণ যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

আমরা কি তাহলে মরব না? চিরকাল বাঁচব?

ড. সিনক্লেয়ার: না (হাসতে হাসতে), চিকিৎসা গবেষণা তাহলে কিসের জন্য বলুন?

আমাদের দীর্ঘ আয়ু আর সুস্থ জীবনের জন্য?

ড. সিনক্লেয়ার: অবশ্যই। ব্যাপারটা একই রকম।

পার্থক্যটা হল - আমরা চাইছি রোগ দেখা দিলে ব্যান্ডেজ না বেঁধে, আগেই রোগের শিকড়টা খুঁজে বের করা।সেটা করতে পারলে তার ফল অনেক ভাল হবে। আর গোটা শরীর তাতে উপকার পাবে।

আমরা চাই না যে হার্টের বয়স কমুক, কিন্তু মস্তিষ্কের ক্ষয় হোক, মস্তিষ্কের বয়স বাড়ুক। সেটা হলে মানুষের হার্টের অসুখ কমবে, কিন্তু আরও মানুষ আলঝাইমার রোগে ভুগবেন।আমাদের এমন পথ বের করতে হবে যেখানে শরীরের সব অংশ সুস্থ থাকবে। আমি সেই পথেই এগোচ্ছি।

এই উদ্ভাবন সামগ্রিকভাবে সমাজকে কীভাবে উপকৃত করবে?

ড. সিনক্লেয়ার: ধরুন, আপনার বয়স ৯০-এর বেশি। আপনি ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত তো হবেন। আপনি নানা ধরনের কাজ করতে পারবেন - ধরুন আলাদা কেরিয়ার, আপনার নাতিপুতিদের সাথে খেলা করতে পারবেন। আপনার সন্তানদের বোঝা হয়ে থাকতে হবে না।

এরপর রয়েছে অর্থকরী সুবিধা।

আমি, আমার সহকর্মীরা এবং লন্ডনের কিছু অর্থনীতিবিদের আনুমানিক হিসাব হল, মানুষের গড় আয়ু মাত্র দু'বছর বাড়াতে পারলে, শুধু মাত্র আমেরিকাতেই আগামী কয়েক দশকে দেশটির অর্থনীতিতে ৮৬ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। আর মানুষকে যদি আরও দশ বছর স্বাস্থ্যকর জীবন দেয়া যায়, তাহলে এই মূল্য দাঁড়াবে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে।

কোথা থেকে এই বাড়তি আয় আসব? মানুষ অসুস্থ হবে না। আমেরিকায় রোগের চিকিৎসায় খরচ হয় হাজার হাজার কোটি ডলার। আমি স্বাস্থ্য সেবার কথা বলছি না - চিকিৎসা সেবার হিসাব দিচ্ছি। চিকিৎসায় এই অর্থ যদি ব্যয় করতে না হয়, তাহলে তা শিক্ষা খাতে বা ধরুন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খরচ করা যাবে।

মেরিল লিঞ্চ ব্যাংকের একটা হিসাব বলছে এই খাতে এখন কয়েক হাজার কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে? এই খাতে এত ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারে এত উৎসাহ কেন?

ড. সিনক্লেয়ার: গোটা বিশ্বে সমাজের এই বিশাল চাহিদার জায়গাটা এখনও পূরণ হয়নি। পৃথিবীতে এমন একজন মানুষকেও পাওয়া যাবে না, যে এই গবেষণার সুফল ভোগ করবে না।

শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি বাড়ানো যায়, সেটা পৃথিবীতে একটা বিপ্লব আনবে। দশকের পর দশক জুড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।এমন একটা বিশ্ব তৈরি হবে, যা আজকের পৃথিবী থেকে ভিন্ন।

বার্ধক্য রোধে কাজ করছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে আপনি সরাসরি যুক্ত। আপনার কি মনে হয় না যে লোকে আপনাকে নিছক একজন গবেষক যিনি বিশ্বের কল্যাণে কাজ করছেন তা মনে না করে ভাবতে পারে এই বিশাল খাত থেকে মুনাফা অর্জনই আপনার মূল লক্ষ্য?

ড. সিনক্লেয়ার: আমার মূল লক্ষ্য মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা। আর তার জন্য ওষুধ যদি লাগে, তাহলে সেই ওষুধ তৈরির জন্য একটা টিমকে তো কাজে লাগাতে হবে।

আমি সেটাই করছি।

আপনি কি ব্যবসায়ী হিসেবে না থেকে সেটা শুধু গবেষক হিসাবে করতে পারতেন না?

না। কারণ একটা ওষুধ তৈরি করতে লক্ষ লক্ষ ডলারের প্রয়োজন।

কিন্তু আপনি কি মনে করেন না যে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে আপনার সম্পৃক্ততার কারণে লোকে আপনার উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে পারে?

আমার বিজ্ঞান তার নিজের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা পাবে। বিজ্ঞান সন্দেহের ঊর্ধ্বে - তা কখনও মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি।

সূত্র : বিবিসি