হাশিম আমলাকে যেসব কারণে ক্রিকেট বিশ্ব মনে রাখবে

হাশিম আমলাকে যেসব কারণে ক্রিকেট বিশ্ব মনে রাখবে

হাশিম আমলাকে যেসব কারণে ক্রিকেট বিশ্ব মনে রাখবে

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন বুধবার। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেও হাশিম আমলা অন্যতম সেরাদের একজন ব্যাটসম্যান।

হাশিম আমলা যখন পেশাদার ক্রিকেটে ব্যাট তুলে রাখার কথা ঘোষণা দিলেন তারপর সাবেক সতীর্থ, সাবেক অধিনায়কের এমন আবেগঘন বার্তা টুইটারে বেশ আলোড়ন ফেলেছে।হাশিম আমলার অবসরের ঘোষণায় বেশ আবেগপ্রবণ হয়েছেন সতীর্থ খেলোয়াড় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ডি ভিলিয়ার্স।

হাশিম আমলাকে নিয়ে ডি ভিলিয়ার্স একটি টুইটে লিখেছেন, “হাশিম আমলা.. কোথা থেকে শুরু করা যায়?” “হয়তো দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছর লেগে যাবে। আমি তোমাকে নিয়ে বই লিখে ফেলতে পারবো,” লিখেছেন ডি ভিলিয়ার্স।হাশিম আমলা ছিলেন এমন এক খেলোয়াড় যিনি সব ফরম্যাট এবং সব আবহাওয়ায় ভালো খেলতেন।

হাশিম আমলার বিশেষত্ব কী?

টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক হাশিম আমলা।টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও তিনি।

বিশ্ব ক্রিকেটে পাঁচজন ক্রিকেটার টেস্ট ও ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটে ২৫টির বেশি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন, হাশিম আমলা তাদের একজন।এই তালিকায় শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, কুমার সাঙ্গাকারা ও ভিরাট কোহলির সাথে আছে হাশিম আমলার নাম।টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই ৪৫ গড়ে ৮০০০ এর বেশি রান করা দুজন ব্যাটসম্যানের একজন হাশিম আমলা।

পনেরো বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আমলা ছিলেন সেরাদের একজন। ফরম্যাট, প্রতিপক্ষ কিংবা উইকেটের ধরণ - কোন কিছুই তার ব্যাটিংয়ে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।কীভাবে আমলা সব ফরম্যাটের ক্রিকেটার হয়ে উঠলেন?আমলা যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন তখন তাকে মনে করা হতো টেস্ট ক্রিকেটার।মাঠে শান্ত চরিত্র এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে এই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছিল বলে মনে করেন দক্ষিণ আফ্রিকান সাংবাদিক ফিরদোজ মুন্ডা।

ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে হাশিম আমলার প্রোফাইলে মিজ মুন্ডা লিখেছেন, আমলা হুট করে সফল হননি, তাকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল।“সেসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন দারুণভাবে,” লিখেছেন মিজ মুন্ডা।তিনি ওয়ানডে ক্রিকেটের দ্রুততম দুই হাজার রান, তিন হাজার রান, চার হাজার রান এবং পাঁচ হাজার রান ছোঁয়ার রেকর্ডের মালিক।আমলার হাত ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার একটা নতুন প্রজন্মের উত্থান হয়েছে।

আমলা শুধু দলের অন্যতম সেরা পারফর্মারই ছিলেন না, তিনি সহ-অধিনায়ক হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছিলেন।দক্ষিণ আফ্রিকার এখনও পর্যন্ত কোন বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। কিন্তু ২০১১ সালে তারা পেয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সেরা টেস্ট দলের খেতাব।আমলা ১৩ ঘণ্টা ব্যাট করে ৩১১ রান তুলে নট আউট ছিলেন সেই ম্যাচে।

এরপর লর্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ে আমলা সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন।এই সিরিজেই ইংল্যান্ডের কাছ থেকে টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বর দলের জায়গা ছিনিয়ে নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।প্রায় ২ বছর এই আধিপত্য ছিল সেই দক্ষিণ আফ্রিকা দলটির।আমলা তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের র‍্যাংকিং অনুযায়ী শীর্ষ টেস্ট ব্যাটসম্যান।পরে আমলাকে টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়েছিল।

যদিও অধিনায়ক হিসেবে আমলা প্রত্যাশিত সাফল্য পাননি, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় থাকবেন তিনি অনায়াসে।আমলাকে 'কিংবদন্তী' ক্রিকেটার মনে করেন অনেকেই এবং পরিসংখ্যানও এই খেতাবের পক্ষে কথা বলবে।

প্রায় ২ দশকের ক্যারিয়ার, ৩৪ হাজারের বেশি রান, টেস্ট ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব, একই সাথে ওয়ানডে ক্রিকেটের বেশ কিছু রেকর্ড আমলার নামের পাশে আছে।হাশিম আমলার আরো কিছু রেকর্ড আছে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে। তিনি ওয়ানডেতে যে ২৭টি সেঞ্চুরি করেছেন তার মধ্যে ২৪টিতেই জয় পেয়েছে দল।আমলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ৫৫টি সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সংখ্যা যোগ করলে মোট সেঞ্চুরি ৮৯টি।

অনেকেই পছন্দ করতো হাশিমকে

হাশিম আমলা মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, এই প্রশ্নের অনেক উত্তর এবি ডি ভিলিয়ার্সের টুইট থেকেই পাওয়া যায়।ডি ভিলিয়ার্স ক্যারিয়ারজুড়ে যত সতীর্থ পেয়েছেন, আমলার কাছেই সবচেয়ে নিরাপদবোধ করেছেন বলেছেন তিনি।

আরও কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট প্রসন্ন অ্যাগোরামের লেখা একটি কলামে, যেখানে তিনি আমলাকে তার দেখা ‘সেরা মানুষ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।হাশিম আমলাকে নিয়ে লেখা একটি কলামে প্রসন্ন অ্যাগোরাম স্মৃতিচারণ করেন, “আমি একবার প্লেটের খাবার শেষ করতে পারছিলাম না। খাবার রেখেই উঠে যাচ্ছিলাম, আমলা খাবার নিজের প্লেটে নিয়ে খেলে নিলেন।”আমলা খাবার নষ্ট করা পছন্দ করতেন না বলে লিখেছেন মি. অ্যাগোরাম।

“আমলার সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল সে খেয়াল করতো সবার ভালো থাকা, খারাপ থাকা। প্রতিদিন খোঁজখবর নিতো। আমি যে রুটি, ভাত মিস করতাম, আমলা দক্ষিণ আফ্রিকায় তার বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে যেত আমাকে।”আমলা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডের লন্ডনের কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব সারের হয়ে ক্রিকেট খেলে।

সারের মাঠ ওভালেই আমলা দক্ষিণ আফ্রিকান টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি খেলেছেন।আমলার টি-টোয়েন্টি রেকর্ডও একেবারে মন্দ বলা যাবে না। আমলার নামের পাশে ৪৪টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৮টি অর্ধশতক আছে, ১৩২ স্ট্রাইক রেটে।আলোচিত টি-টোয়েন্টি লিগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে দুটি সেঞ্চুরিও আছে আমলার।

হাশিম আমলা মুসলিম রোল মডেল?

ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার মইন আলী ২০২১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমলাকে প্রথমবার টেলিভিশনে দেখে তিনি ক্রিকেটের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।এখন সেই মইন আলী শুধু একজন সফল ক্রিকেটারই নন, ব্রিটিশ মুসলিমদের জন্যও একজন উদাহরণ।জনপ্রিয় আম্পায়ার আলিম দার একবার বলেছিলেন, আমলাকে দেখে তিনি দাড়ি রাখা শুরু করেন, “যাতে করে মানুষ জানে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে একজন মুসলমান আম্পায়ারিং করে।”

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে দীর্ঘ সময় প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল একটি অ্যালকোহল বেভারেজ কোম্পানি, আমলা সচেতনভাবেই জার্সিতে ওই কোম্পানির লোগো এড়িয়ে চলতেন।দুই হাজার একুশ সালে ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের হামলায় সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় হাশিম আমলা ইন্সটাগ্রামে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, “নেলসেন ম্যান্ডেলা আজীবন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীন না হলে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের এতো বছরের সংগ্রাম অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”

সূত্র : বিবিসি