করোনাকালে বেসরকারী শিক্ষকদের দায়িত্ব নিবে কে?

করোনাকালে বেসরকারী শিক্ষকদের দায়িত্ব নিবে কে?

ফাইল ফটো

১। বাংলাদেশে মার্চ মাস থেকে ধরলে করোনা মহামারী ৩ মাস অতিক্রম করেছে। করোনা একটি অতি ক্ষুদ্র অণুজীব, যার সংক্রমণ মানুষকে দ্রুত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং বাংলাদেশে এ মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে এবং সংক্রমণ ছাড়িয়েছে লাখের ঘর। প্রতিদিন এ সংক্রমণের হার বেড়েই চলছে সাথে মৃত্যুর সংখ্যা। করোনার পুরো বিশ্বই বেসামাল। সেখানে বাংলাদেশের কথা বলাই বাহুল্য। যার প্রভাব খুব দ্রুত আচ্ছন্ন করে ফেলেছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা  ব্যাবস্থা ও কর্মসংস্থানের সবগুলো খাত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের সরকারও শিল্প কারখানা,  ব্যাংক, ব্যাবসা বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলোকে চালিয়ে রাখার এক ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূলে যেহেতু দেশ ও জাতির আগামি প্রজন্ম শিশু, কিশোর ও যুবক, তাই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। আমরাও মনে করি এ সিদ্ধান্ত খুবই যৌক্তিক। কারণ আজকের শিশুরাই আগামি দিনের ভবিষ্যৎ। 

২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অস্তিত্ব সচল ও বর্তমান। শিক্ষার্থীদের সবকিছু বন্ধ করে রাখলে  তাদের মধ্যে মনস্থাত্ত্বিক বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে করোনা পরবর্তীকালে আরও ভয়ংকর। তাই প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বেছে নিয়েছে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠে যুক্ত রাখার ব্যাবস্থা। এতে শিক্ষার্থীরা দুটো বিষয়ে উপকৃত হচ্ছে। যেমন-

ক) শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট সিলেবাসের সবটুকু না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ের পাঠ গ্রহণ হয়ে যাচ্ছে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণ করার মাধ্যমে কিছুটা মূল্যায়নও করা যাচ্ছে। যদিও পরবর্তী সময় সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই  শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বা উত্তোরণের ব্যাবস্থা করা হবে। তবে শিক্ষার্থীরা এ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে যুক্ত থাকছে এবং এতে করে তাদের মনোবিকাশে  কাজ করছে। 

খ) শিক্ষকদের এ ক্লাস ও মূল্যায়ন ব্যাবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় যে কাজটি হচ্ছে, তা হলো শিক্ষার্থীরা বাসায় অলস সময় না কাটিয়ে তারা নিজ নিজ পাঠে ব্যাস্ত থাকছে। এতে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা আসার সুযোগ পাচ্ছে না। 

৩। বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে কয়েক লক্ষ শিক্ষক কাজ করেন। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতাই এসকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে এবং দেশের কর্ম সংস্থানের অভাবের কারণেই একই শিক্ষাগ্রহণ করেও শিক্ষকগণ স্বল্প বেতনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে যাচ্ছেন। কখনো কখনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অধিক দায়ীত্ব নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে এ সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। যদিও এ সকল শিক্ষকগণ স্বল্প বেতন দিয়েই বাসা ভাড়া, বাজার সদাই, সন্তানের শিক্ষা ও অন্যান্য চাহিদা মিটিয়ে থাকে। কেউ কেউ ছাত্র ছাত্রীদেরকে বাসায় বা ব্যাচে পড়িয়ে কিছু বাড়তি আয় না করতে পারলে হয়তো শহর এলাকায় কোনো মতেই তাদের টিকে থাকা সম্ভব হতো না। বলে রাখা ভালো, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের উৎস হচ্ছে একমাত্র শিক্ষার্থীদের বেতন। তবে করোনার প্রভাবে অধিকাংশ অভিভাবকের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নেই। উপার্জনের জায়গাগুলো বন্ধ কিংবা চাকরীক্ষেত্রের দুরবস্থার কারণে কষ্টে-শিষ্টে দিন পার করছে। 

৪। কিন্তু সত্য কথাটি হচ্ছে দেশের এ সকল শিক্ষকরা গত ৩ মাস জুড়ে খুব মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সরকারি বা  এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদিও পুরোপুরিই বেতন-ভাতা পাছেন কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি  প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন একদমই নেই, কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম মাত্র বেতন হাতে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এ দুই শ্রেণির শিক্ষকরা আজ তিন মাস ধরে এ অবস্থার শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। শিক্ষাকে আমরা জাতির মেরুদণ্ড বলি আর এই মেরুদণ্ডের কারিগর বলি শিক্ষকদের। আর শিক্ষক এমন এক শ্রেণি, যে না পারে কারো কাছে হাত পাততে, না পারে কোনো খাবারের বা সাহায্য পাবার লাইনে দাঁড়াতে। এ তিন মাস যদি আরও তিন মাসে গিয়ে ঠেকে তাহলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা খুব বড় ধরনের মানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে ডুবে হারিয়েও যেতে পারে। কারণ যদি বাসা ভাড়া, মাসের বাজার কিংবা নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় চাহিদা কিংবা প্রয়োজনীয় ঔষধ পথ্য সংগ্রহের সকল উপায় যদি বন্ধ হয়ে যায় তখন অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। 

৫। প্রশ্ন হচ্ছে কে দেখবে বেসরকারি শিক্ষকদের এ দুরবস্থা? সরকার না প্রতিষ্ঠানের মালিক? দেশের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা রাতদিন করোনা মোকাবেলায় নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা  দিচ্ছেন। দেশের খেটে খাওয়া দিন মজুর থেকে রিকসা-ভ্যানচালক কিংবা ভিক্ষুক থেকে বেকার ও ভবঘুরে মানুষদের জন্যে সরকার প্রাণান্তর চেষ্টা চালাচ্ছেন। সাথে কাজ করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। কিন্তু আমরা শিক্ষকরা  কোথায় যাবো? শেষ পর্যন্ত কি আমরাও সাহায্যের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো? তার উত্তর গত ৩ মাসে আমাদের কাছে নেই। আর সামনের দিনগুলোতে এর উত্তর আর চাওয়ার হয়তো দরকার হবে না। ইতোমধ্যে দেখেছি শিক্ষকরা রিকসা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, শিক্ষকরা মুটের কাজে নেমেছেন, শিক্ষকরা রাস্তার মোড়ে ভ্যানে সবজি বিক্রী  করছেন। তারপর আর কি দেখতে হবে তা সময়ই বলে দিবে।

৬। কিছুদিন আগে সরকারি এক নির্দেশে কিছু প্রণোদনার কথা বলে আমাদের বিকাশ নাম্বার ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে  নিয়ে গেছে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। তারপর কোনো সংবাদ আর ফিরে আসেনি, হয়তো কখনো আসবে। যদি  আসেও তাতে কি হবে সেই প্রণোদনার অর্থ দিয়ে? ক’মাসের বাড়ি ভাড়া হবে? ক’মাসের মাসিক বাজার হবে? ক’মাসের সন্তানের পথ্য হবে?  ক’মাসের ঔষধ হবে? এর উত্তর আমি আমরা কেউ জানি না। একটি শিক্ষকের পরিবার একটি মাস কোনো রকমে অতিক্রম করতে কি পরিমাণ অর্থ লাগতে পারে তা পরিমাপ করা খুব কঠিন নয় কিন্তু এ পরিমাপ কে করবে? আর কবে করবে? সেটাই আজকে আমার লেখার মূল বিষয়। 

৭। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন, সরকারি ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে কিছু ভাবুন এবং দ্রুত ব্যাবস্থা নিন। এ করোনাকালে একজন শিক্ষকের বেঁচে থাকার   জন্যে প্রতিমাসে অন্তত ১০ হাজার টাকার ন্যুনতম প্রণোদনা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় বেতনের নির্দিষ্ট অংশ প্রাপ্তির মাধ্যমে বেঁচে যেতে পারে এ সকল শিক্ষকদের বিপন্ন জীবন। অন্তত মানসিকভাবে শক্ত থাকলেই আবার সময় এলে পুরো উদ্যমে তারা কাজে নেমে পড়তে পারবে। আর বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ ও পাঠ কার্যক্রম সচল রেখে আগামি প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর-যুবকদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দরে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

৮। আজকের এই লেখাটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য একটি শান্তনামূলক আমার প্রয়াস । তবে আমি বিশ্বাস অরি, যতই সামান্য হোক না কেনো, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজরে যদি  লেখাটি আসে তাহলে তিনি অবশ্যই এ সকল শিক্ষকদের মানবেতর জীবন উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন এবং তার প্রতিকারের একটি সুব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন। যার ফলশ্রুতিতে করোনা পরবর্তীকালে শিক্ষকরা আবার অধিক মনোবল নিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন এবং বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তাদের পাঠদানে যুক্ত রাখতে পারবেন। 

মোঃ কামরুল হুদা

 ভাইস প্রিন্সিপল

কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

উত্তরা,ঢাকা।