রমজানের চেতনা

রমজানের চেতনা

রমজান মানে আত্নত্যাগ

 

প্রতি বছর বিশ্বের সর্বত্র এবং সব নৃতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির মুসলমানরা রমজান মাসের পুরোটাই প্রত্যুষ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালন করেন। ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে রমজান হলো সর্বাধিক বরকতময় মাস। কিন্তু মাসটিকে রহমতে ধন্য করেছে কোন বিষয়? কেন মুসলিমরা এ মাসে রোজা রাখেন? এসব প্রশ্ন এবং তার সাথে আরো কিছু দিক এখানে আলোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আপনার পরিচয় ঘটবে মাসব্যাপী সে আধ্যাত্মিক যাত্রার সাথে, যাতে সারা দুনিয়ায় ১৪০ কোটির বেশি মুসলমান শামিল হয়েছেন।
আল কুরআন এ প্রসঙ্গে যা বলেছে, তার অর্থ এটা রমজান মাস যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক এবং সে দিকনির্দেশনার স্বপ্রমাণিত প্রমাণ আর সত্যকে মিথ্যা থেকে পার্থক্যকারী মাপকাঠি হিসেবে (আল বাকারাহ ২:১৮৫)। আসলে রমজানের পুরো মাসই আল কুরআন নাজিল হওয়ার উদযাপন। কুরআনকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘যারা সৎ কাজ করে, তাদের জন্য পথনির্দেশনা ও করুণা হিসেবে (লুকমান ৩১:৩)। আল্লাহ আল কুরআনের মাধ্যমে দিয়েছেন পথের দিশা পাওয়ার আলো। এটা মানবজীবনকে কল্যাণ ও পুণ্যের পথে পরিচালিত করে এবং মানুষের আত্মাকে মন্দ ও পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই আলোকবর্তিকা পাঠিয়ে আল্লাহতায়ালা করুণাই করেছেন। মাহে রমজান হচ্ছে এরই উদযাপন।
রমজানে পানাহার ও যৌনসংসর্গ থেকে বিরত থেকে মুসলমানরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় এই পথনির্দেশনার জন্য। আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা লাভ এবং জীবনে তাঁর উপস্থিতির সুগভীর সচেতনতা সৃষ্টির উপায় হিসেবে রোজা রাখা হয়। আল্লাহর উপস্থিতির অনুভূতি মানুষের মনের গহিনে যে প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়, তার ফলে সে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও সত্যের সপক্ষেই থাকে। একইভাবে, নিজেকে রক্ষা করে অন্যায় থেকেÑ এমনকি যখন তা করা সহজ কিংবা বেশি প্রলুব্ধকর হয়, তখনো।
এ কারণেই আল কুরআনে রমজানে রোজা রাখা সম্পর্কিত আয়াতের (আল-বাকারা ২:১৮৩-১৮৫) পরপরই আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার সবচেয়ে আন্তরিক সম্পর্কের উল্লেখ করা হয়েছে। তাই বলা হয়েছে, ‘যখন আমার বান্দারা তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি প্রকৃতপক্ষে নিকটবর্তীÑ আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শুনি যখন কেউ আমাকে ডাকে; অতএব তাদেরকে আমাকে শুনতে দাও, আর আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে দাও, যাতে তারা সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারে (আল বাকারা ২:১৮৬)।
রোজার মাধ্যমে আত্মা যখন মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আত্মসমর্পণে নিয়োজিত হয়, তখন এই স্বীকৃতি দেয়া হয় যে, আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবন দিয়েছেন উপহার ও আমানত হিসেবে এবং এটাকে সৎকাজে ব্যবহার করতে হবে যাতে আল্লাহর করুণা, দয়া, ভালোবাসা, বদান্যতা, প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়। আসলে কুরআন বলছে, আমাদের আত্মার স্বভাবজাত প্রবণতা হচ্ছে এক আল্লাহর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস এবং ইবাদাতে পুণ্যকর্মের সাহায্যে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা (আর রুম ৩০:৩০)। সে মোতাবেক, ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ বা গুনাহ হচ্ছে নিজের আত্মার ওপর অত্যাচার। কারণ এর মাধ্যমে আত্মাকে এমন অবস্থায় ঠেলে দেয়া হয় যা তার স্বভাব ও লক্ষ্যের পরিপন্থী। সূরায়ে আলে ইমরানের ১১৭ আয়াতসহ অনেক আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে। যখন কেউ পাপে লিপ্ত হয়, সে নিজের কুপ্রবৃত্তির দাস এবং নিজের আবেগতাড়নার হাতে বন্দী হয়ে পড়ে (আল ফুরকান ২৫:৪৩)।
অর্থাৎ, রোজা বা সিয়াম সাধনা মানুষের নিম্নস্তরের প্রবৃত্তিকে দমন করে। সেই সাথে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয়ের অনুভূতি, তথা সৎ কাজের আকাক্সক্ষা বাড়িয়ে দেয়। এভাবে রোজা আত্মাকে করে বন্ধনশৃঙ্খল থেকে মুক্ত। জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো থেকে নিজেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বঞ্চিত করে আমরা আত্মসংযমের শিক্ষা নিই। ক্রোধ, প্রতিহিংসা, মিথ্যাচার, চুরি বা পরস্বাপহরণ, যৌন অনাচার প্রভৃতি মন্দ কাজ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা লাভ করি। এ কারণে রাসূল মুহাম্মদ সা: বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ রোজা রাখো, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার কিংবা জোরে কথা বলা তার উচিত হবে না। কেউ যদি তাকে অপমান করে কিংবা তার সাথে ঝগড়ার চেষ্টা করে, তার বলা উচিত : আমি রোজা পালন করছি। রাসূলুল্লাহ সা: মুসলমানদের আরো সতর্ক করে দিয়েছেন যাতে রোজা রাখা এমন প্রথায় পর্যবসিত না হয়, রোজাদারের চরিত্র ও স্বভাবের ওপর যার কোনো প্রভাব পড়ে না। তিনি বলেছেন, ‘যদি রোজা রেখে মিথ্যাচার ও অসদাচরণ থেকে বিরত না হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
ব্যক্তিচরিত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যেসব গুণের বিকাশ ঘটানো সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য, তার একটি হলো আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি বিনয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণার মাধ্যমে রোজাদার উপলব্ধি করে। আল্লাহতায়ালার দয়া-দাক্ষিণ্য, অর্থাৎ রহমত ও রিজক ব্যতিরেকে মানুষকে চরম কঠিন ও দুঃসহ অবস্থায় পড়তে হতো। রোজা রাখার মধ্য দিয়ে মানুষ বিনয়-নম্রতার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আর এটা সৎকর্মশীলদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য কখনো আন্তরিক খোদাভীতির সহযাত্রী হতে পারে না।
রোজা রেখে সমাজের সম্পদশালী, সৌভাগ্যবানরা লাখ লাখ মানুষের সে বেদনা ও যাতনা, দুঃখ ও দুর্ভোগ উপলব্ধি করে, যা প্রতিদিন খাদ্য ও পানীয়সহ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সৃষ্টি হয়। মাহে রমজানের রোজা ধনী ও দরিদ্র, সচ্ছল ও নির্বিত্ত এবং প্রাচুর্যের অধিকারী ও অভাবীর মাঝে যোগসূত্র। এই অভিজ্ঞতা থেকে দয়া ও সহমর্মিতা বাড়ানো উচিত। অভাবগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্য সম্পদ ও সময় ব্যয়ের মতো মহানুভবতায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। বিশেষ করে এই রমজান মাসে মুসলমানদের উৎসাহ দেয়া হয় ক্ষুধার্তকে খাওয়াতে এবং ভালো কাজে সম্পদ ব্যয় করতে। শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, লঙ্গরখানা প্রভৃতি স্থাপন এই ভালো কাজের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলের সা: হাদিসে বলা হয়েছে, রমজানে ভালো কাজের প্রতিদান বছরের অন্য সময়ের তুলনায় দশ গুণ। এই বরকতময় মাসে সর্বপ্রকার সৎকর্ম ও বদান্যতার দশ গুণ প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন আল্লাহতায়ালা। আর তা দেয়া হবে ইহকাল ও পরকাল, উভয় ক্ষেত্রেই।
রমজান থেকে ফায়দা হাসিল করে আল্লাহর রহমত ও সওয়াব অর্জনের জন্য মুসলমানদের উৎসাহিত করা হয়েছে প্রতিবেশীর সাথে খাবার ভাগ করে নিতে এবং সেহরি ও ইফতারে শরিক করার জন্য মেহমানদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি অনেক বাড়িয়ে দিতেও বলা হয়েছে। রমজান মাসে বিশেষ ইবাদাত হিসেবে তারাবির নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে মসজিদে। তখন বেশিরভাগ মসজিদই মুসল্লিতে থাকে পরিপূর্ণ। এসবের মধ্য দিয়ে রমজান সর্বদাই এমন পরিবেশের জন্ম দেয় যে, সামাজিক বন্ধন খুবই সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। মাহে রমজানের বিদায়ে মুসলমানের হৃদয় ব্যথা অনুভব করে। তারা মাসটির আগমনের অনেক আগে থেকেই এর জন্য প্রতীক্ষায় থাকে।
মোটকথা, রমজান হলো বিশ্বমানবতার জন্য আল-কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনার উদযাপন। কুরআন হচ্ছে সৎ কাজের পথনির্দেশিকা, আর মন্দ কাজের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি। ঈমান ও আমল, অর্থাৎ বিশ্বাস ও সৎকার্যের কুরআনী আদর্শের সাথে জীবনকে সুসামঞ্জস্য করা চাই। এজন্য রোজা পালনের বিধান রাখা হয়েছে; যাতে ব্যক্তি হিসেবে আমরা আল্লাহতায়ালার ঘনিষ্ঠ হই এবং তাকওয়া বা তাঁর ভয় আরো বৃদ্ধি পায়। এ লক্ষ্যে পুরো মানবদেহকে ইতিবাচক নৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বাহনে পরিণত করা সম্ভব। আর এমন পরিবর্তনের ফলে কৃপণতার বদলে বদান্যতা, ক্রোধের পরিবর্তে ধৈর্য প্রতিষ্ঠিত হবে; প্রতিহিংসার স্থান ভালোবাসা এবং যুদ্ধের স্থান শান্তি দখল করে নেবে। অর্থাৎ বিশ্বে মন্দের জায়গায় আসবে ভালো।
রাসূলুল্লাহর সা: মুখ দিয়ে আল্লাহ যা বলেছেন, তাকে হাদিসে কুদসি বলা হয়। রোজা পালনের ফলে সৎ কাজের প্রভাবে ব্যক্তির মাঝে যে রূপান্তর ঘটে, তার চমৎকার উল্লেখ দেখা যায় একটি হাদিসে কুদসিতে। তাতে বলা হয়েছেÑ ‘সর্বাধিক প্রিয় কাজ যার মাধ্যমে আমার বান্দা আমার আরো কাছে আসে, তা হলো আমার নির্দেশ মেনে চলা। আর আমার বান্দা অতিরিক্ত সৎ কাজ করে আমার ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে, যে পর্যন্ত না আমি তাকে ভালোবাসি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি হই শ্রবণ, যা দিয়ে সে শোনে; আমি হই দৃষ্টি যার দ্বারা সে দেখে, আমি হই হাত দুটো যার মাধ্যমে সে কাজ করে আর হয়ে যাই পদযুগল যার সাহায্যে সে হাঁটে। এবং যদি সে আমার কাছে চায়, তাকে আমি দিই। যদি সে চায় আমার তরফ থেকে নিরাপত্তা, আমি তাকে রক্ষা করি।’
লেখক : ‘দি কোরআন ফর ডামিজ’ গ্রন্থের প্রণেতা
ভাষান্তর : মীযানুল করীম