আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করার ফজিলত

আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করার ফজিলত

ছবিঃ সংগৃহিত।

‘তাওয়াক্কুল’ বা আল্লাহর ওপর ভরসা করা, এটি মুমিন বান্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত পছন্দ করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘আল্লাহ তায়ালার ওপরই ভরসা রেখো, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও।’ (সূরা মায়িদা-২৩)
এমনিভাবে ইরশাদ হয়েছে-‘আল্লাহ তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। অতএব মুমিনগণ আল্লাহর ওপর ভরসা করুক।’ (সূরা আত-তাগাবুন-১৩)
আরেক আয়াতে এভাবে আসছে- ‘মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতগুলো পড়া হয়, তখন তা ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা প্রতিপালকের ওপর ভরসা করে।’ (সূরা আল আনফাল-২)
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয়, মুমিনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো- ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’ বা আল্লাহর ওপর ভরসা করা।
আর আল্লাহর ওপর ভরসার অর্থ হলো এই যে, কোনো কাজে শুধু নিজের যোগ্যতা এবং ক্ষমতার ওপর ভরসা না করে একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।
তবে হ্যাঁ, আল্লাহর ওপর ভরসার অর্থ এই নয় যে, আমি নিজে একদম হাত গুটিয়ে বসে থাকব কোনো চেষ্টা করব না। আর আসমান থেকে আমার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেয়া হবে? বিষয়টি এমন না; বরং যেকোনো বিষয়ে আগে নিজের পরিপূর্ণ চেষ্টা-যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা ব্যয় করব, এরপর বিষয়টি আল্লাহর কুদরতের ওপর ছেড়ে দেবো তাঁর ওপর ভরসা করে, যে মাবুদ আমার পক্ষ থেকে আমি যতটুকু চেষ্টা করেছি এবার পূর্ণতা দেয়ার মালিক আপনি।
এক হাদিসে আসছে, একজন সাহাবি নবীজী সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা: আমি কি উট বেঁধে আল্লাহর ওপর ভরসা করব? নাকি উট ছেড়ে দিয়েই আল্লাহর ওপর ভরসা করে রেখে যাব? উত্তরে নবীজী সা: বললেন, ‘আগে উট বাঁধো তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো, যাতে কোনো দুর্ঘটনার কারণে উট হারিয়ে না যায়।’ (সুনানে তিরমিজি-২৫১৭)
আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলাটা আল্লাহ এতটাই পছন্দ করেন যে, কুরআন কারিমের ভেতরে আল্লাহ তায়ালা এমন বান্দাকে ‘ভালোবাসেন’ তার জন্য আল্লাহই ‘যথেষ্ট হয়ে যাবেন’ এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যেমন ধরুন কোনো কর্মচারী যদি তার নিজের সমস্ত দায়-দায়িত্ব মালিকের হাতে ন্যস্ত করে দেয় এবং বলে যে আমার মালিক আমার এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে আমি রাজি, আমার কোনো আপত্তি নেই, তখন মালিক অবশ্যই তার ব্যাপারে কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নেবেন এবং অনেক খুশিও হবেন বটে।
ঠিক তেমনি কোনো বান্দা যখন তার সমস্ত চেষ্টা ক্ষমতা ব্যয় করার পরে ভরসা করে সেই মহান মালিক রাজাধিরাজ আল্লাহর ওপর, তখন তিনিও অত্যন্ত খুশি হন।
যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘এরপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করুন, আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)
আল্লাহর ওপর ভরসার উপকারিতা
এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মুমিন বান্দার ওপর শয়তান কখনো আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। পবিত্র কুরআনুল কারিমের ভাষায়- ‘তার আধিপত্য চলে না তাদের ওপর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আপন পালনকর্তার ওপর ভরসা রাখে।’ (সূরা নাহল-৯৯)
আল্লাহর ওপর ভরসাকারী বান্দাকে আল্লাহ ভালোবাসেন, পবিত্র কুরআনে এভাবে আসছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯) অতএব আল্লাহর ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া বান্দার জন্য আর কী হতে পারে?
এমন বান্দার জন্য আল্লাহ নিজেই যথেষ্ট হয়ে যান অর্থাৎ এমন বান্দার সাথে আল্লাহ আছেন, তো যার সাথে আল্লাহ আছেন তার কিসের ভয়? কিসের অভাব?
যেমনিভাবে সূরা তালাকে আল্লাহ বলেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন।’ (সূরা তালাক-৩)
আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারী বান্দা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হাদিসে এসেছে, নবীজী সা: বলেন, ‘আমার সামনে একবার বিভিন্ন নবীর উম্মতকে পেশ করা হয়। তখন আমি নবীদের সাথে তাদের উম্মতকে দেখলাম। কোনো কোনো নবীর সাথে একটি দল, কারো সাথে ১০ জন, কারো সাথে পাঁচজন, আবার কোনো নবী একা একাই চলছেন। হঠাৎ বড় একটি দল দেখে আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞেস করলাম। এরাই কি আমার উম্মত? তিনি বললেন না। আপনি ওই দিকে দেখুন। নবীজী সা: বলেন, আমি সেদিকে তাকাতেই বিশাল একটি দল দেখলাম। জিবরাইল বললেন, এরাই আপনার উম্মত। এদের সম্মুখভাগের ৭০ হাজার লোক হিসাব ছাড়া ও কোনো আজাব ছাড়া, জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন, তারা কারা? জিবরাইল বললেন, তারা ওই সব লোক যারা অবৈধভাবে ঝাড়ফোঁক দেয় না এবং নেয়ও না এবং পাখির মাধ্যমে গণনা করে শুভ-অশুভ নির্ধারণ করাকে বিশ্বাস করে না; বরং সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা অর্থাৎ তাওয়াক্কুল করে।’ (বুখারি-৬১৭৫) আল্লাহর ওপর ভরসাকারী বান্দার রিজিকের জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ হয়ে যান। হাদিসে এসেছে, মহানবী সা: বলেন, ‘তোমরা যদি যথাযথভাবে তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর ভরসা করতে তাহলে আল্লাহ তায়ালা ওই পাখির মতো তোমাদের রিজিক দান করতেন যে পাখি সকালে খালি উদরে বের হয় আর বিকালে উদরপুর্তি করে বাসায় ফিরে আসে। অর্থাৎ সকাল বেলা পাখি যেমন সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বের হয় এবং সবশক্তি ব্যয় করে আহার খুঁজতে থাকে, ঠিক তেমনি মানুষ যদি আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল তথা ভরসা করে সবশক্তি ব্যয় করে রিজিক অন্বেষণ করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালা পাখির মতো সেই মানুষকেও অবশ্যই রিজিক দান করবেন।
লেখক : গবেষক, আলেম