তরিকুল ইসলামের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে নানা কর্মসূচি
ফাইল ছবি
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তরিকুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যশোর জেলা ও স্থানীয় বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে তরিকুল ইসলামের কবর জিয়ারত, স্মরণসভা, এতিমখানা-মাদরাসায় খাবার ও বস্ত্র বিতরণ। সোমবার মৃত্যুবার্ষিকী হলেও গত শনিবার থেকে এসব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার বিকেল তিনটায় যশোর টাউন হল ময়দানে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
একনজরে তরিকুল ইসলাম
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির কথা উঠলেই সবার আগে স্মরণে আসে তরিকুল ইসলামের নাম। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সবসময় নিজ জেলা যশোরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন ও স্বপ্ন দেখাতেন। সেজন্য তার চিরবিদায়ে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর যশোর ঈদগাহ ময়দান রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।
যশোরবাসীর চাওয়া ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার। সেই চাওয়া পূরণ করেছেন তরিকুল ইসলাম। তার হাতের ছোঁয়ায় যশোরসহ এ অঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, মসজিদ-মন্দিরের ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যশোরের ১০০ শয্যার হাসাপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং একটি আধুনিক করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপন করেন। বেনাপোল ও নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং যশোর রেলওয়ে স্টেশনের উন্নয়ন তার হাত দিয়েই হয়েছে। যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যশোর কালেক্টরেটের বিশাল দ্বিতল ভবন, জজ কোর্ট, আইনজীবী ভবন, সার্কিট হাউসের নতুন ভবন, এলজিইডি ভবন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর শিক্ষা বোর্ড স্কুল ও কলেজ, যশোর সরকারি এমএম কলেজের বর্ধিত ভবন ও খালেদা জিয়া ছাত্রীনিবাস, সিটি কলেজের ছাত্রবাস, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্র, শিক্ষা বোর্ডের বহুতল ভবন, সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা), শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালক), গণগ্রন্থাগার ছাড়াও অসংখ্য উন্নয়ন করেছেন তিনি।
জননেতা হওয়ার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হন তরিকুল ইসলাম। নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে তাকে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে তার টার্গেটে পরিণত হন তরিকুল ইসলাম ও তার পরিবার। এ সময় কয়েক দফা কারাগারে যেতে হয় তাকে। তবে সব মামলায় তরিকুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যরা আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রামাণিত হন।
১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা আলহাজ আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।
১৯৬১ সালে তিনি যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজনৈতিক জীবন
তরিকুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন।
১৯৬৬ সালে যশোর এম এম কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণের সময় প্রথম রাজনৈতিক মামলায় আটক হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্যে তাকে রাজবন্দি হিসেবে ৯ মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন তরিকুল ইসলাম।
১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ডাকা ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বাকশালের বিরোধীতা করে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এরপর বিএনপিতে যোগ দেন এবং যশোর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে যশোর-৩ (সদর) আসনে বিপুল ভোটে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারে মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এরপর স্বৈরাচার এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারির পর তরিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেন। প্রথমে তাকে এরশাদের দলে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু প্রচন্ড সাহসিকতায় সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দেন। এরপর এরশাদের বিশেষ বাহিনী তরিকুল ইসলামসহ তার বিশ্বস্ত বেশ কিছু শীর্ষ নেতার এরশাদ হত্যা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গুম করেন। কয়েক মাস তার কোনো সন্ধান না পাওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে ভয়েস অব আমেরিকার তৎকালীন প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী শরনাপন্ন হন। তিনি একটি শক্তিশালী রিপোর্ট করার পর স্বৈরশাসক তরিকুল ইসলামসহ আটক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে প্রেরণ করে। গুম থাকাকালে তরিকুল ইসলামের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
দীর্ঘ কারাভোগ শেষে জামিনে বেরিয়ে আসার পর আবারও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং দলের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পরে খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ সালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান তরিকুল ইসলাম। এ সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০'র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরিকুল ইসলামের অগ্রণী ভূমিকা ছিল দেশব্যাপী আলোচিত বিষয়। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির রাষ্ট্র পরিচালনার সময় তিনি পর্যায়ক্রমে সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রথমে খাদ্য ও পরে তথ্য এবং সর্বশেষ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
তরিকুল ইসলামের স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম যশোরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক। তরিকুল ইসলামের অবর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির হাল ধরেন তিনি। এছাড়া খুলনা বিভাগীয় বিএনপির দায়িত্ব তাদের উত্তরসুরী কনিষ্ঠ পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের কাঁধে। আর জ্যেষ্ঠ পুত্র শান্তনু ইসলাম সুমিত, তরিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত গণমানুষের কণ্ঠস্বর দৈনিক লোকসমাজের প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।