পাবনায় জাতভিত্তিক আমন ধানের ফলন ও দামে কৃষক খুশি

পাবনায় জাতভিত্তিক আমন ধানের ফলন ও দামে কৃষক খুশি

ছবি: প্রতিনিধি

পাবনায় চলতি মওসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে চাষিরা বিভিন্ন মাঠে পুরোদমে শুরু করেছেন জমির ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ। ধান কাটা-মাড়াই কাজে যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় চাষিদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা হতে আসা শ্রমিকরা। উপজেলার সর্বত্রই এখন ধান কাটা-মাড়াই কাজের ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। কৃষক, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি ও শ্রমিকরা আগাম ধান কাটতে পেরে খুবই খুশি।

আমন ধান কাটার পরই আলু,সরিষা, ফুলকপি, ছোলা, গমসহ বিভিন্ন রবি সশ্য চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে অধিকাংশ জমি। যার ফলে কৃষকের কষ্টে অর্জিত আমন ধান ঘরে তুলতে গৃহস্থদের পাশাপাশি গৃহনীরাও সমানতালে ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করছেন।

এবার উপশি জাতের ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড ধানের ফলনও অনেকটা ভালো হয়েছে। প্রতিবিঘায় উপশি জাতের ধানের ফলন হয়েছে ১৭ থেকে ১৮ মন পর্যন্ত। আর হাইব্রিড ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ১৮ থেকে ১৯ মন। এবার  জেলায় বিভিন্ন প্রকার ব্রি-ধান, স্বর্ণা, রনজিত, কাটারী ভোগসহ অর্ধশতাধিক জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে। চলতি মওসুমে চাল উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৮২ হাজার ৯১৬ মেঃটন ধান।

মওসুমের শুরুতেই রোপা আমন ধান কাটতে পারায় মহা খুশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী এবং কৃষি শ্রমিকরা। আগাম স্বল্প ময়াদী জাতের এ ধানের ফলন ও বাজারদর ভাল পাচ্ছেন কৃষকরা। ধান কাটার পর একই জমিতে রবি ফসল আবাদের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। জেলার কিছু কিছু অংশে কয়েক দফা বন্যা, ভারি বর্ষন ও ঝড় হাওয়ায়সহ নানা প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে পাবনায় রোপা আমন ধানের চাষ করে কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জাত ভিত্তিক আমন আবাদের মধ্যে রয়েছে সরসরি, আজলদিঘা, দিঘা, ভাওয়ালিয়া, বড় ভাওয়ালিয়া, লাল ভাওয়ালিয়া, মোল্লাদিঘা, ধলদিয়া, বাশিরাজ, কচরা, বরণ এবং পাকড়ী। 

এসব জাতের মধ্যেই রয়েছে হাইব্রিড ও উফশী জাতের ১৩টি ও ২৯ জাতের স্বল্পমেয়াদী ধানের আবাদ।

চলতি বছর জেলার ৯ উপজেলায় মোট ৫৪ জাতের আমন ধান আবাদ হয়েছে। জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৯৫ হাজার ৬শ’ ৮২ হেক্টর জমি; পক্ষান্তরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ২শ’ ১৬ মেট্রিক টন চাউল। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪০ হাজার ২শ’ হেক্টরে বোনা আমন যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৩শ’ মে.টন চাউল। পক্ষান্তরে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৯১৬ মে.টন রোপা আমনের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আবাদের টার্গেট রয়েছে ৫৫ হাজার ৪৮২ হেক্টর। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কৃষক অতিরিক্ত আবাদ করেছেন। 

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় স্বল্পমেয়াদী ঊফশী জাতের ২৯টি জাতের মধ্যে স্বর্ণা, বিনা-৭, ব্রি ধান-৩৩, ৪৯, ৫১, ৫২, ৫৬, ৬২, ৬৬, ৭০, ৭১,৭৪, ৭৫, ৮৭সহ  আগাম জাতের ধান চাষ হয়েছে ৫৩ হাজার ৭শ’ ০২০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া ১৩টি হাইব্রিড জাতের আমন যেমন ধানিগোল্ড, তেজ, এজড-৭০০৬, সোনার বাংলা-১, এগ্রে-১১, হিরা-২, এসিআই-১, সুরভী,সিনজজটাসমূহের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২ হাজার ২শ’ ৫০ হেক্টর।   

ইতোমধ্যেই স্বল্পমেয়াদী আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হওয়ায় খুশি কৃষকরা। এ পর্যন্ত (১৪ নভেম্বর) ১৬ হাজার ৭শ’ ১০ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। এতে করে কার্তিকের এ অভাবের সময়ে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবার আগাম নতুন ধান ঘরে ওঠায় আগাম নবান্ন উৎসবও শুরু হয়েছে গ্রাগুলোতে।

আমন উৎপাদন এলাকা হিসেবে বিশেষ পরিচিত পাবনা সদর উপজেলার চকউগ্রগড় গ্রামের কৃষক খোরশেদ শেখ ও বকুল সরদার জানান, স্বল্পমেয়াদী ধান আবাদ করেছি। বাজারে ধানের দামও ভালো। তারা আরো জানান, ধান আবাদে বিঘা প্রতি ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হলেও ১৬ থেকে ২০ মন ধানের ফলন হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার টাকার ধান পাওয়া যাচ্ছে। ফলে খরচ খরচা বাদে ১২/১৩ হাজার লাভ হচ্ছে। এরকম ধানের বাজার থাকলে কৃষকরা লাভবান হবেন বলে এ দু’কৃষক জানান। এছাড়াও বাড়তি আয় হিসেবে বিঘা প্রতি ধানের খড় ( বিচালি/পোয়াল) বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। একই উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের কৃষক আবুল বাশার জানান, ব্রি-ধান-৬২ ও বিনা-৭ আবাদ করে বেশ ভালো ফলন পেয়েছেন তিনি। আগাম ধান পেয়ে বিক্রি করে দামও পেয়েছেন বেশি। সব মিলে এবার ধান আবাদ করে কৃষকরা খুবই লাভবান হয়েছেন।  

রোববার (১৫ নভেম্বর)  পাবনা সদর উপজেলার উত্তরা লের বিখ্যাত বাণিজ্যিক হাট ছিল টেবুনিয়া। হাঠে আসা  ধান ব্যবসায়ী মোঃ আবুল হোসেন ও মজিবর রহমান এবং ধান বিক্রেতা মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, আজ ( রোববার ) হাটে ৯৫০ টাকা থেকে ১,১৫০ টাকা মন দরে ধান বিক্রি হয়েছে। ফলে কৃষক আশানুরূপ ধানের দাম পেয়ে তারা খুশি। এদিকে খালি জমিতে রবি ফসলের চাষের জন্য শুরু করেছেন কৃষকেরা। আগাম খালি হওয়া জমিতে আলু, সরিষা, পেঁয়াজ, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের রবি ফসলের চাষ করে কৃষকেরা বাড়তি আয় করতে পারবেন বলে কৃষি বিভাগ জানান।

শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগাম ও স্বল্প মেয়াদী এই জাতের ধানের ভালো ফলন পাওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আগাম ধান তাদের পারিবারিক চাহিদা মেটাচ্ছে। এছাড়াও বাজারে ধান ও গো খাদ্য হিসাবে খড়ের দাম ভালো পাওয়ায় আর্থিক ভবে লাভবান হচ্ছে বলে জানান কৃষকরা। ধান কাটা পর এসব জমিতে সরিষা, মুগ ডাল ও আলু চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে শানিকদিয়া চরা লের কৃষক রোববার কাশিপুর বাজারে আবেদ আলী, মঈন উদ্দিন ইকবর হোসেন জানান।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মো: আবদুল কাদের জানান, কাটা-মাড়াইয়ের মাঝামঝি সময়ে স্বল্প মেয়াদী এ ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কাজ করছে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর। আগাম ধান কাটা পর এসব জমিতে সরিষা, মুগ ডাল, আলু ও গম চাষ করতে পারে সে জন্য সব ধরণের সহায়তা দেওয়ার কথা জানালেন এই কৃষি কর্মকর্তা। এসব ফসল আবাদের জন্য কৃষকদের মাঝে উন্নতমানের বীজ প্রদানসহ মাঠ কর্মীরা হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। এত করে কৃষকরা আরো উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি)  মোঃ আবদুল কাদের জানান, আমন ধান চাষাবাদ যখন শুরু হয়, তখন অতি বৃষ্টিপাতে জেলার কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নীচু জমির পানি সহজে নিস্কাশন না হওয়ার ফলে চাষিরা কিছুটা বিপাকে পড়েছিলেন। পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। যারফলে চাষিদের আমন ধান চাষাবাদে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। এছাড়াও আমন চাষিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য আমাদের দপ্তরের সকল কর্মকর্তা/কর্মচারী সব-সময় তৎপর ছিলেন। ধানের বাম্পার ফলনের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি, সেই সুফলও পেয়েছি। এখন রবি সশ্য আবাদের জন্য উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। আমাদের মাঠ কর্মীরা কৃষকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিচ্ছেন উন্নতমানের রবি সশ্য আবাদের জন্য। হাতে-কলমে সব ধরণের টেকনিক্যাল পদ্ধতি এ্যাপ্লাই করছেন কৃষকদের কল্যাণার্থেআমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।