হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো

হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো

জাহিদ হাসান (নয়ন)

জীবনে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নেওয়া। শিক্ষকতা পেশার মাঝে আছে আনন্দ,আছে রসের সমারোহ। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিশিষ্ট  বিজ্ঞানী ড.এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন,“ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা সেটা স্বপ্ন নয়,স্বপ্ন সেটাই যার প্রত্যাশায় তোমাকে ঘুমাতে দেয় না”। কত নির্ঘুম রাত আমাকে অতিবাহিত করতে হয়েছে শুধু স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করতে। অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছিল আমার জীবনে।

ছোট বেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি আমার আলাদা অনুরাগ ছিল। তবে পারিবারিক কাজ কর্ম দেখাশোনার পাশাপাশি পড়া লেখা করতে হতো। বলে রাখি আমার পরিবারে মাত্র ৪ জন সদস্য। তারা হলেন আমার শ্রদ্ধেও বাবা-মা,আমার একমাত্র বড় ভাই আর আমি। তারা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমাদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় অনেক বাঁধার সম্মুখিন হতে হয়েছে। পড়া-লেখা কখনো কখনো স্থিমিত হওয়ার পর্যায় চলে গিয়েছিল তবুও হাল ছাড়েনি। মনের গহিনে লালন করে রেখেছিলাম শিক্ষক হব। আল্লাহর অশেষ কৃপা ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। পিতা-মাতা কষ্টে থাকবে বলে পরিবার থেকে টাকা পয়সা চাইতে পারতাম না। হয়তো টাকা চাইলে দিতে পারতো তবে ধার করে। কিন্তু সেদিক বিবেচনা করে চাইনি। ২০০৯ সালে দাখিল (এস এস সি) পরীক্ষা দিই। এবং সেখান থেকে এচঅ-৫.০০ পাই। তখন থেকে পড়ার প্রতি প্রবল ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। ২০১১ সালে ভর্তি হই আলিম (এইস এস সি) এ । আলিম পরীক্ষায় এচঅ-৪.৯২ পাই। মনের ভিতর এক কষ্ট ছিল যে, সামান্যের জন্য অ+ হলো না? তবে অনেকে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিল বলে আজ আমার এই পর্যন্ত আসা।

অ্যাডমিশন দিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তারপর থেকে আমার জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল যে, পিতা-মাতার মনের আশাকে পূরণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ চিত্র দেখে আমি মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যেতাম। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেও বড় ভাই আমাকে উৎসাহ দিত। সারাদিন পড়ালেখা করছি কিনা বার বার ফোন করে শুনতো। তার শাসন আমাকে এ পর্যন্ত আনতে সহায়তা করেছে। আল্লাহর কাছে বড় চাওয়া ,আল্লাহ যেন আমার ভাইকে উত্তম প্রতিদান দান করেন। বর্তমান সময়ে পড়ালেখা শেষ করে যারা বেকার অবস্থায় আছেন তাদেরকে সমাজের মানুষ একটু যেন খারাপ দৃষ্টিতে দেখে। আমার অবস্থা এমন হয়েছিল যে, বাড়িতে মা-বাবা যাওয়ার কথা বলতো কিন্তু বেকারত্বের কথা ভেবে বাড়িতে যেতে মন চাইতো না। আর যদিও বাড়িতে যেতাম, তাহলে বাড়িতে যতদিন অবস্থান করতাম ততদিন বিশেষ কোন জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতাম না। যখন আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব ফোন করে বলতো “পড়ালেখা শেষ করে আর কতদিন এভাবে বেকার অবস্থায় থাকবে ? একটা কিছু করো। বর্তমান টাকা-পয়সা ছাড়া চাকরি পাওয়া সহজ নয়। তাই বয়স থাকতে থাকতে ভালো কোন কোম্পানিতে ঢুকে পড়।” আর এ সমস্ত কথা আমাকে খুব পীড়া দিত। আমার এ মনের কথাগুলো সকল বেকার ভাইবোনদের মনে কথা বলে আমার মনে হয়। সকলেই এ পরিস্থিতির স্বীকার । তবে পি এস সি যে গরিবদের একটা আস্থার যায়গা সেটা হাতে-নাতে তার প্রমাণ পেলাম।

যে কোন জিনিস সাধনা করলে তার ফল অনেক ভালো হয়। পরিশ্রম করলে মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিদান দিতে কার্পন্য করেননা। সারা বিশ্বে যখন মহামারী করোনার প্রকোপ বিস্তার লাভ করেছিল তখনও সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রেখে মেসে থেকে পড়ালেখা করেছি। বাড়িতে একদিন থাকা মানে এক বছর মনে হতো। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে করোনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। মনে হয়েছিল এ বছরটায় হয়তো জীবন থেকে মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ সালে ভালো একটা সংবাদ পেলাম যে, রেজাল্ট শিটে সরকারি হাইস্কুলে (নন-ক্যাডার) নিজের রোল নাম্বারটা দেখতে পেলাম। সে এক অন্যরকম আনন্দ; যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মায়ের কাছে ফোন করে যখন বললাম- ‘মা, আমার সরকারি হাইস্কুলে চাকরি হয়ে গেছে।’ তখন মা আমার কিছুক্ষণ কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা তোদের জন্য সারাক্ষণ দোয়া করেছি ।

তবে একটা কথা বলে রাখি মা-বাবার দোয়া কখনো বিফলে যায় না। সকলে চেষ্টা করেন, তার উত্তম প্রতিদান হাতে হাতে পেয়ে যাবেন। আর আমার জন্য সকলে দোয়া করবেন আমি যেন সততা ও নিষ্ঠার সাথে চলতে পারি।

জাহিদ হাসান (নয়ন)

সহকারী শিক্ষক (নন-ক্যাডার)

সুপারিশ প্রাপ্ত

zahidiu2016@gmail.com