বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতদূর?
বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ। ছবিঃ সংগৃহিত।
"সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা,আশা তার এক মাত্র ভেলা।"
কবির ছন্দটি চিরন্তন সত্য। আমাদের দুঃখ কষ্টের সংসার জীবনে আশাই একমাত্র শেষ ভরসা। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক দায়িত্ব সরকারের উপরই ন্যাস্ত থাকে। সরকার পরিবর্তনশীল কিন্তু জনগনের জীবন যাত্রার প্রতিটি মৌলিক চাহিদার পূরণোর ঝুঁকি রাষ্ট্রই বহন করে। উন্নত বিশ্বের সাথে আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের সুষ্পষ্ট পার্থক্য এখানেই। আমাদের আগামীর গন্তব্য যেখানে অনিশ্চিত সেখানে প্রায়ই আমরা পশ্চিমা বিশ্বের জনগণের জীবন যাত্রার মানের সাথে তুলনা করি, যা প্রকৃতার্থে হাস্যকর।
অর্থনীতিতে ভঙ্গুর একটি জাতিকে শুধুমাত্র রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো কালে কালে শুধু মাত্র স্বপ্ন দেখিয়ে ৫৫ বছরের দুর্গম পথ অতিক্রম করতে বাধ্য করেছিল তথাপি স্বপ্নের সফল সমাপ্তি নেই, তবে আছে দুঃস্বপ্নের বন্ধুর গন্তব্য। স্বপ্নবাজ জাতিকে স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা কালে কালে স্বপ্নের গল্প শুনায়ে শুনায়ে আরও কঠিন সময় ও বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। স্বপ্ন দ্রষ্টা ফেরিওয়ালারা এটাও জানতো স্বপ্নবাজ এ জাতির যখনই স্বপ্নের ঘোর কাটবে তখনই ঘুরে দাঁড়াবে, প্রতিবাদি থেকে বিপ্লবী হবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো ফেরিওয়ালা পরিবর্তন হয় তবুও স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন অধরাই থেকে যায়।
আমরা কি একবার ভেবেছি জাতিকে তার নির্দিষ্ট গতি পথে রাখতে আমাদের সন্তানদের প্রকৃত পারিবারিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমন্বয়ের প্রয়োজন।আমরা 'আদর্শ লিপি' অথবা "বাল্য শিক্ষা"র মতো মূল্যবান বই পাঠ দান ছাড়াই বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চ বাসনা নিয়ে মাতৃ ভাষায় জোর না দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষার যাত্রা শুরু করেছি। ফলে সন্তানরা না দেশী, না বিদেশী কোন ভাষায়ই শিক্ষিত হয়নি। আদর্শ লিপি'র অ তে "অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর", আ তে "আলস্য দোষের আকর" একথাগুলো একজন শিশুর কাছে কত বেশী প্রয়োজন ছিল তা আমরা মন ও মননে স্থান দেইনি। ফলে সন্তানদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান পিতা-মাতার প্রত্যাশা পূরণে ব্যবধান যোজন যোজন। আমরা ৯০'র গণ অভ্যুত্থান দেখেছি, আমরা এটাও দেখেছি প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনায় ত্রুটি ও দুর্নীতির কারণে প্রায় সাড়ে ৬ বছর কিভাবে কারা অন্তরীণ ছিলেন। আমরা ২০০৬ সালে প্রধান দু'টো রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের কারাগারে প্রেরণের বহু মাত্রিক চিত্র দেখেছি। আমরা বিশ্বব্যাপী প্রকৃতির নির্মম বাস্তবতা কোভিডের (করোনা) দুঃস্বপ্নের ক্রান্তিকাল দেখেছি, অকালে আপনজনদের হারিয়েছি কিন্তু কোন শিক্ষা কি আমরা প্রকৃতি থেকে নিয়েছি?
প্রেসিডেন্ট এরশাদ দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হককে নিয়ে আসতে দেখেছি। সাবেক পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশ কিছু অরাজনৈতিক প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মানুষদের মন্ত্রী পরিষদ ও উপদেষ্টা পরিষদে মন্ত্রী মর্যাদায় স্থান দিতে দেখেছি, কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। কারন জাতি হিসাবে আমরা নীতি, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের শিক্ষা তো নেইনি বরং দুর্নীতি, ত্রাস, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ ও নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত কর্ম যজ্ঞের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছিলাম। দেশ ও দেশের মানুষের কথা না ভেবে গণতন্ত্রের লেবাসে আমলাতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপণ করেছি। ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী, অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাদের রাজনীতিতে প্রতিস্থাপন করে রাজনীতির গতি পথকে ক্রমান্বয়ে জনগণের জন্য দুর্গম করেছি। রাজনৈতিক নেতা জন্মানোর আতুরঘর হিসাবে পরিচিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকে সমূলে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে অরাজনৈতিক লোকদের সকল পরামর্শ গ্রহন করেছি। ফলে রাজনীতির চির চেনা জায়গা গুলোতে অর্বাচীন, জনবিচ্ছিন্ন ও দুর্নীতিবাজরা সস্মুখ সারিতে স্থান করে নিয়েছিল। সকল অরাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও আমলাদের রক্তচোষা গোষ্টি যাদের দুর্দণ্ড প্রতাপে এবং লবিং ও দলীয় বিভাজনের কারণে রাজনীতি তার প্রকৃত রূপ হারিয়েছিল। রাজনীতি কি আবার স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করবে না পুরানো রীতিতেই চলবে তা এখনো জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ?
২৪'র ছাত্র-জনতার বিপ্লব সার্বজনীন বিপ্লবে রূপ নেয়ার অন্যতম কারন হলো রাজনীতি স্বরূপে জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা। এ কারনে জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্য বোধ সমুন্নত করতে ও অতীত রাজনৈতিক নেতাদের রাহু গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষ পতিত সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে এসেছিল। রাজনীতি স্বরূপে প্রত্যাবর্তন দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। তাই নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূছকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান করে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিখ্যাত ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন সরকার গঠন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূছের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার মাত্রা ছিল অস্বাভাবিক। ড. ইউনূছ আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বে কর্মরত বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটা সরকার গঠন করলেও জনগণ তথা অত্র সরকারকে সমর্থিত বিপ্লবী গোষ্টিকে গত এক বছরে তাদের কাজের দক্ষতা প্রদর্শনে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সে শঙ্কার পূর্বাভাষ ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ, জনাব আশিক চৌধুরী, ড. খলিলুর রহমানদের মতো প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও গুণিজনরা সারা জীবন বিদেশী সংস্কৃতির শিক্ষা নিয়ে ও চর্চা করে স্বদেশের অচেনা সংস্কৃতি বিনির্মানে জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন। কিন্তু একবারও ভাবেননি বিষয়টি যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল ততোটা সহজ নয় কারন বিনির্মানে প্রথমে প্রয়োজন জাতির আশা আকাংখা সম্পর্কে সম্যক ধারনা নিয়ে প্রয়োজনীয় চর্চা ও জ্ঞান আহরণ করে পুনর্গঠনে হাত দেয়া। অথচ কোন প্রকার ধারনা, চর্চা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ ছাড়াই তারা জাতির কাছে যোগ্য প্রমান করে স্বপ্ন সারথী হতে চেয়েছিলেন। তারা পুরানো সংবিধান ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান রচনার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছেন, বিদেশী বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এনে জাতিকে বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগের এক রূপকথার জগতে ক্ষণিকের জন্য নিতে পেরেছিলেন ঠিক কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তব যে এক নয় তা বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিডব্যাক বা অনাগ্রহ ইতিমধ্যে প্রমানিত হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত শিল্প বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুনর্জাগরণ বা রেঁনেসার বিন্দু মাত্র পূর্বাভাষ জাতির সেন্সরে ধরা দেয়নি। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের নামে জাতিসংঘ মহাসচিবকে বাংলাদেশে এনে কোট-টাই পরা মানুষটিকে টুপি পাঞ্জাবী পরিয়ে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গার নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর ও কক্সবাজারকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দিয়ে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন সময়ে মানচিত্র পরিবর্তনের মতো দেশদ্রোহী বক্তব্য যখন সরকারের উচ্চ মহল থেকে মিডিয়ায় আসে তখন বীর জাতি হিসাবে বিশ্বে মাথা উঁচু দাঁড়ানোর পরিচিতির বদলে জাতি লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দুশ্চিন্তায় সাহস হারাতে বসেছে। চীন, ভারত, মায়ানমারের ভূ-রাজনীতিতে মার্কিনী ষড়যন্ত্র ও হস্তক্ষেপ ক্রমেই জাতির কাছে স্পষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে, নতুন দিনের আশায় জাতি যে পরিবর্তনের আশায় বিপ্লব করেছিল অথচ ঐ সব মৌলিক বিষয়গুলোর প্রকৃত সমাধান আশা নিরাশায় দুলছে। বিপ্লবী, সাধারণ জনগণ জানেন না সমস্যার কখন সমাধান হবে? কিভাবে সমাধান হবে? আর এসব মৌলিক বিষয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যত জাতিকে পুনরায় আন্দোলনের পথে প্রত্যাবর্তনের সুস্পষ্ট শঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলে জাতি তথা রাজনৈতিক কিছু দল প্রাপ্ত সমীকরণ নিয়ে এখনো ঘুমের ঘোরে রয়েছে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের দুর্বোধ্য সমীকরণ আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়ার শঙ্কায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অশণি সংকেত তথাকথিত রাজনৈতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্কদের হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান জাতীয় নির্বাচন, সংবিধান সংশোধন, জুলাই সনদ প্রনয়ণ, পিআর পদ্ধতির সংযোজন সর্বোপরি ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ জাতিকে এক অজানা শঙ্কার গতি পথে তুলে দিয়েছে। যাদের উপর ভরসা করে দেশে ছাত্র-জনতার বিপ্লব হলো অথচ বিপ্লবোত্তর দেশে জাতি আজ এক অজানা লক্ষ্য নিয়ে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে অগ্রসর হচ্ছে, যার ফলাফল যে, অনিশ্চিত ও ভয়াবহ হতে পারে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
মীর্জা বাহাদুরকলামিস্ট ওরাজনৈতিক বিশ্লষেক