ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ

ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ

ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ

সব মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। আদি পিতা-মাতা হজরত আদম-হাওয়া আ: থেকে সবার উৎপত্তি। কিন্তু কালক্রমে মানুষ এই ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন জাতি, বংশ, গোত্র ও বর্ণের ভিত্তিতে। অথচ মানবতার দাবি হচ্ছে বিশ্বজোড়া প্রেম-ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা।

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড হলো তাওহিদ। মহান আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পরস্পরের গভীর যোগসূত্র ও ভালোবাসার বন্ধনের দাবি হচ্ছে, এক মুসলিম অপর মুসলিমের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। সে যে দেশের হোক, যে ভাষারই হোক। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু-ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমাদের উপর রহম করা হয়।’ (সূরা হুজুরাত-১০)

‘মুমিন নর-নারী সবাই একে অন্যের বন্ধু-সহযোগী। তারা সৎকাজের আদেশ করে, অসৎকাজে বাধা দেয়, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তাওবা-৭১)

অখণ্ড ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সম্প্রীতি ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত একটি দেহের মতো। যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি-৬০১১, সহিহ মুসলিম-২৫৮৬)অন্য হাদিসে নবীজী সা: বলেছেন, মুমিন মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ, মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার জমি সংরক্ষণ করে ও তার অনুপস্থিতিতে তাকে হিফাজত করে।’ (সুনানে আবু দাউদ-৯৪৮)

নবীজী আরো ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর একটি ইমারতস্বরূপ। যার এক অংশ অপর অংশকে মজবুত করে রাখে।’ এ সময় তিনি উভয় হাতের আঙুলগুলো জড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। (সহিহ বুখারি-৫৬৮০)ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো তাকওয়া ও কল্যাণের কাজে মুসলিমরা একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। নিজেদের মাঝে সম্পর্ক সৌহার্দ্য বজায় রাখবে। অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকবে।

সমাজ জীবনে মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই পারস্পরিক সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, সমঝোতা প্রভৃতি সদাচরণ সমাজে অন্যায় ও জুলুমের অবসান ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে মানবসভ্যতাকে গতিশীল করে তোলে। তাই দেখা যায়, মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে অখণ্ড সমাজ গঠন করেছে। তখন তারা অগ্রগতি ও শান্তির উচ্চতর মার্গে পৌঁছে গেছে। আর যখনই বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখনই পতন হয়েছে অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসের পাতায় এ রূপ ঘটনা অসংখ্য।

কুরআন-হাদিসের উপর্যুক্ত নির্দেশনা যখন সব গ্রাম-শহরের বাস্তবায়িত হবে তখন সব ভূখণ্ড একত্রিত একটি সমাজের রূপ নেবে, যে সমাজের চোখ ব্যথা হলে পুরা দেহ ব্যথিত হয় যেমনটা নবীজী সা: বলেছেন। তখন কোনো অঞ্চল দুর্যোগ দুর্বিপাকে পড়লে ওমনি অন্যান্য অঞ্চল বিপদের মোকাবেলায় ছুটে আসবে।

একজন মুসলিমের অন্তরে ঈমান যত বেশি থাকবে, সে মুসলিমদের সমস্যাকে তত বেশি গুরুত্ব দেবে, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সে ততটাই গুরুত্বের সাথে নিজের মধ্যে ধারণ করবে। এই উদ্বেগ-গুরুত্ব দেখে তার ঈমানের উষ্ণতা আন্দাজ করা যাবে। হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে এই মর্মে বাইয়াত গ্রহণ করেছি যে, আমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করব, জাকাত আদায় করব এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করব।’ (সহিহ বুখারি-৫৭, সহিহ মুসলিম -৫৬)

রাসূলুল্লাহ সা: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিমদের একে অন্যের হক ও ভ্রাতৃত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখার জোর নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম মনে করে মানুষের বংশ-গোত্র, ধন-দৌলত কিছুই মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষ মানবতার বিরাট বাগিচার এক একটি ফুল।

ইসলামী অনুশাসন যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না বিধায় আজ সব দেশে সর্বত্র ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে। কারো ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি এতটাই হ্রাস হয়ে গেছে যে, এখন সে কোনো অঙ্গে ব্যথা পেলে মোটেই টের পায় না। যাকে প্যারালাইসিস আক্রান্ত হওয়া বলা চলে। ফলস্বরূপ মুসলিমদের ওপর বস্তুবাদের বিজয় উল্লাস হচ্ছে।

দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুসলিমরা অপমানিত লাঞ্ছিত বঞ্চিত ও রক্তের হোলিখেলার শিকার হচ্ছে। সব কুফরি শক্তি মুসলিমদের বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে, অথচ আফসোস! নিজেদের রক্ষায় আমরা এখনো এক হতে পারিনি। এ বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে পরিত্রাণে এবং নিজেদেরকে রক্তের হোলিখেলা থেকে বাঁচাতে সবার মাঝে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বীজ বপন সময়ের অপরিহার্য দাবি।

মুফতি শাব্বীর আহমদ : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ।