চলনবিল অঞ্চলে চলছে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ, রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার

চলনবিল অঞ্চলে চলছে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ, রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার

চলনবিল অঞ্চলে চলছে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ, রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার

এক ঝলক দেখে মনে হতে পারে হলুদ সাগর! মৌমাছির গুঞ্জন আর দিনের আলোর নাচতে মাঠের পর মাঠ  তাদের আধিপত্য বজায় রয়েছে। বোরো ধান চাষের আগে পাবনা অঞ্চলসহ চলনবিলের ১৩টি উপজেলা মাঠের এই দৃশ্য। সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ এলাকার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সরিষা চাষ।এলাকার কৃষকরা জানান, শুধু দাম বৃদ্ধিই এই ফসল চাষের একমাত্র কারণ নয়; এই ফসল চাষে অন্য যেকোনো ফসলের তুলনায় চাষাবাদ ও শ্রমও কম লাগে।এদিকে চলনবিল অঞ্চলে পুরোদমে চলছে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ। কিন্তু নীতিমালা না থাকায় সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ খাত থেকে।

কৃষকরা জানান, সরিষার বাম্পার ফলন এবং বাজারে ন্যায্য দাম এবং লাভজনক হওয়য় গত কয়েক বছর ধরে তারা এ ফসল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে উন্নত বারি-৯,১১,১৪,১৫,১৭ ও ১৮, টরি-৭, হাইল্যান্ড ও সম্পদ জাতের সরিষার আবাদ করা হয়েছে।অতীতের চেয়ে এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন চাষিরা।

সম্পতি পাবনার ভাংগুড়া উপজেলার উপর দিয়ে বন্যা বয়ে গেছে। বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় বিরুপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে কৃষকেরা আগাম জাতের সরিষার আবাদ করেছেন। স্বল্প সময়, কম খরচ ও কম পরিশ্রমে এই ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। পরে সরিষার জমিতে কম খরচে বোরো আবাদ করেন চাষিরা। ফলে সরিষা বিক্রির টাকা দিয়ে ইরি-বোরো আবাদের খরচ কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারেন।

উপজেলার আদাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক রায়হান আলী বলেন, ‘১০বিঘা জমিতে উন্নত জাতের টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন। গত বছরেও আবাদ ভালো হয়েছিল। চলতি মৌসুমেও আবাদ ভালো হবে। প্রতি বিঘা  থেকে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হবে।উপজেলার পাটুল গ্রামের কৃষক ইউনুস আলী বলেন, ‘সম্প্রতি বয়ে যাওয়া বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম জাতের সরিষার আবাদে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষকেরা। এছাড়া সরিষার উৎপাদনে কম সার, সেচ, কীটনাশক ও নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। খরচ কম ও স্বল্প সময় এই ফসল হয়ে থাকে। আবার ওই জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। প্রতি বিঘায় সরিষার ফলন ৬ থেকে ৭ মন পর্যন্ত হয়ে থাকে।’

মৌচাষি সমিতির সূত্রে জানা যায়,এবারও কুষ্টিয়া, চাপাই নবাবগঞ্জ,বগুড়া,যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা,সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ  দেশের বিভিন্ন জেলার ৮শ’৬৯ জন মৌচাষী মধু সংগ্রহের জন্য চলনবিলের সরিষার ক্ষেতের পাশে ৮৮ হাজার ৪৩২ মৌ-বাক্স বসিয়েছেন। চলতি মৌসুমে এ অ ল থেকে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চলনবিল কেন্দ্রীক ১৩ উপজেলার কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে চলনবিলের ১৩ উপজেলায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীলসহ বিভিন্ন জাতের সরিষার চাষ হয়েছে। ফলনও ভালোর হবে বলে কৃষকদের বুক ভরা আশা। প্রতি বছর চলনবিলের সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠে। এতে একদিকে মৌচাষীরা মধু সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন; অন্যদিকে সরিষার ফলনও বাড়ছে।

পাবনা জেলা ও উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন,‘চলতি মৌসুমে চলনবিল অ ল  থেকে ২ হাজার মেট্রিক টনের ও বেশি মধু পাওয়া যাবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। তিনি জানান,তার মোট ৫০টি মৌ-বাক্স রয়েছে।সংগৃহীত এসব মধু ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার মধুর দাম বেশি। ফলে মধু সংগ্রহ ও বাজার অনুপাতে প্রায় ২৫ কোটি টাকারও বেশি মধু উৎপাদন হবে চলনবিল অ লে।উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহাদ আলী তার একশ’টি মৌ-বাক্স থেকে প্রতি সপ্তাহে মধু উৎপাদন হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ মণ।এদিকে চলনবিলের মধুর গুনাগুন ভালো হওয়ায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে মধু কিনতে ভিড় শুরু করেছে।

চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এএ মাসুমবিল্লাহ জানান, কৃষি বিভাগও মধু সংগ্রহের বাক্স প্রদান করেছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মৌসুমে চলনবিলের সরিষা ফুল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এবং বিভিন্ন গাছ-পালায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মৌচাক থেকে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন মধু সংগৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

ভাংগুড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এনামুল হক জানান, ‘সরিষা একটি আগাম ফসল। এ উপজেলায় বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় কৃষকেরা আগাম সরিষা চাষ করেছেন। এরপর একই জমিতে ইরি-বোরো আবাদ হবে। এ বছর কৃষকদেরকে সরিষা চাষে ব্যাপক সচেতন করা হয়েছে। কৃষি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।’

মাঠ পরিদর্শণকালে সিরাজগঞ্জের আলাইপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত কুমার শান্ত বলেন, "এ বছর আমি ৭৫ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় আট থেকে নয় মণ সরিষার ফলন পাওয়া গেলেও উৎপাদন খরচ তিন থেকে চার হাজার টাকা।" প্রতি বিঘা থেকে ২০ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা লাভ হবে। আমিও মধু সংগ্রহ করছি। দলগাসা  গ্রামের আরেক কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, সরিষা চাষ খুবই লাভজনক। "আমি এ বছর বারি-১৪ জাতের সরিষা চাষ করেছি এবং গত বছরের তুলনায় বেশি লাভের আশা করছি।"কৃষি কর্মকর্তা বাবু হোসেন জানান, ভালো ফলনের জন্য তারা কৃষকদের সব ধরণের সহায়তা ও নির্দেশনা দিচ্ছেন।সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহে গতি এসেছে এ অঞ্চলে।দেশের বিভিন্ন স্থান চলনবিলে থেকে আসা মধু আহরণকারীরা মৌমাছি পালন ও মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

চাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সরিষা ক্ষেতে মধুর বাক্স স্থাপনে মৌমাছি পরাগায়নে সহায়তা করলে সরিষার ফলন ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। দেশের প্রায় ২১ হাজার সংগ্রাহক চলনবিলে মধু আহরণ করছেন।

মধু সংগ্রহকারী ইয়াসিন কবির শুক্রবার গোপালগঞ্জ থেকে আসেন চলনবিলে। তিনি সিরাজগঞ্জ কামারকন্দের রসুলপুরে যাওয়ার পথে এ প্রতিনিধিকে জানান,‘ এবার তিনি ১০০টি মধুর বাক্স স্থাপন করেছেন। গত বছর স্থাপন করেছিলেন ৮৮টি বাক্স। সমিতির গত বারের আশ্বাসের ভিত্তিতে এবার ১২টি বাক্স বেশি স্থাপনের অনুমতি পেয়েছি।’ তিনি বলেন,‘বর্তমান প্রতি কেজি মধু পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।’সেলিং গ্যারান্টি না থাকায় প্রায় নির্ধারিত হারে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। "ফলে আমরা হেরে যাচ্ছি," তিনি আরও বলেন।

ছুরমান আলী জানান, তিনি সাপ্তাহিক  থেকে ৬ মণ (৪০ কেজি = ১ মণ) মধু আহরণসহ ৩০০টি মধু বাক্স স্থাপন করেছেন। মধুর বাক্সে সরিষার ভালো ফলন হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, অনেকেই মধু কিনতে মাঠে আসেন। তিনি আরও বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে অনেক মৌমাছি মারা যাচ্ছে। তাই মরা মৌমাছির জন্য আশানুরূপ মধু উৎপাদন করা কঠিন হবে বলেও জানান তিনি।

কথা হয় মধু চাষি সমিতির এক নেতা আবদুর রশীদের সাথে ওই চলনবিলে। তিনি বলেন,“ "আমরা সরকারী বা বেসরকারী কোন আর্থিক সহায়তা পাই না। আমাদের গ্রামের ঋণদাতাদের কাছ থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিতে হয়," তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি আরও জানান, মধু বিক্রির  কোনো নিশ্চয়তা নেই। মধু রপ্তানি হলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে বলে তিনি পরামর্শ দেন।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জানায়, চলনবিল ঘিরে কয়েকটি জেলার ১৩টি উপজেলা রয়েছে। যদি একটি জেলার অন্তর্ভূক্ত থাকতো তা’হলে ফসল আবাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থাকতো। তাই কোন জেলাতেই চলনবিলের জন্য আলাদা কোন টার্গেট নেই। যেসব উপজেলা যে জেলার অন্তর্ভূক্ত, চলনবিলকে সেই সেই জেলার মোট আবাদের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী  স্বপন এ প্রতিনিধিকে বলেন,“মধু একটি বৃহৎ শিল্প। সরিষা চাষ ও মধু আহরণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষ করে চলনবিলে সরিষার সময় টন টন মধু পাওয়া যায়। সরিষা ফুলের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মধু আহরণকারীরা চলনবিলে আসেন মধু সংগ্রহের জন্য। তারা সেখানে সমিতির পক্ষ থেকে বন্টককৃত এলাকায় বাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। সেই মধু ওই সমিতির কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য। ফলে মধু সংগ্রহকারীরা মধুর প্রকৃত মূল্য যেমন পান না; তেমনি সরকারের কোন নীতিমালা না থাকায় প্রতি বছর সরকার এ খাত থেকে বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বি ত হচ্ছে। তাই রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে সরকারকে এ খাতটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিৎ। চলনবিলকে কেন্দ্র করে সরকারের অনুগ্রহে পাবনায় যদি মধু শিল্প গড়ে তোলা যায়; তবে সরকার প্রচুর পরিমান রাজস্ব আদায় করতে পারবে। এ জন্য এ ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।”