শারীরিক সুস্থতায় অন্তরের ভূমিকা

শারীরিক সুস্থতায় অন্তরের ভূমিকা

শারীরিক সুস্থতায় অন্তরের ভূমিকা

মানুষ শরীর ও মনের পারস্পরিক সমন্বয়। মানবদেহের চেয়ে অন্তর বা মন অতিক্ষুদ্র একটি অঙ্গ। অথচ তা গোটা দেহের প্রাণকেন্দ্র। মধ্যমণি। নিয়ন্ত্রক। রাজা। বাকি সব অঙ্গ তার প্রজা। তাই সব অঙ্গ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে গোটা মানবদেহে অন্তরই একমাত্র আল্লাহর লক্ষ্যস্থল। ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের শরীর ও বাহ্যিক আকৃতির প্রতি নজর করেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তরের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আর তিনি তাঁর আঙুলের দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন।’ (মুসলিম-৬৩১০)

শারীরিক সুস্থায় কলবের ভূমিকা : ইসলামে ভালো-মন্দের বিচার করা হয় অন্তর বা ব্রেন/মগজ দিয়ে। যার অন্তর ভালো তার সব ভালো। যার অন্তর খারাপ তার সব খারাপ। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো ‘কলব’। (বুখারি, কিতাবুল ঈমান-৫০) সুতরাং শারীরিক সুস্থায় কলব বা অন্তরের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরসীম এবং অনস্বীকার্য।

ইসলামে শারীরিক সুস্থতার গুরুত্ব : ইসলামে শারীরিক সুস্থতার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তাই নেশা ও যাবতীয় মাদকদ্রব্যকে হারাম করেছে ইসলাম। শারীরিক সুস্থতা ফরজ ইবাদতের ওপর অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ইসলামে। কোনো আমল ও বিনিদ্রায় দীর্ঘ রাত জাগরণ এবং অনাহারের মাধ্যমে শরীরিক কষ্ট সহ্য করা হারাম। হাদিস শরিফে রাসূল সা: এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।

হজরত আবদুুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘হে আবদুল্লাহ! আমাকে কি এ খবর প্রদান করা হয়নি যে, তুমি রাতভর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকো এবং দিনভর সিয়াম পালন করো? আমি বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, এরূপ করো না; বরং সিয়ামও পালন করো, ইফতারও করো, রাত জেগে ইবাদত করো এবং নিদ্রাও যাও। তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে; তোমার চোখেরও তোমার ওপর হক আছে এবং তোমার স্ত্রীরও তোমার ওপর হক আছে।’ (বুখারি, কিতাবুন নিকাহ-৪৮২০)

যে কারণে কলব রুগ্ণ এবং নষ্ট হয় : কলব নষ্ট বা রুগ্ণ হয় মূলত আত্মসমালোচনা ও কলবকে নিয়ন্ত্রণ না করা এবং দীর্ঘ আশার কারণে। (রিসালাতুল মুসতারশিদিন-১১০) যারা নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আত্মসমালোচনা করে তারা বুদ্ধিমান। যারা নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে না তারা নির্বোধ ও অক্ষম। (সুনানে তিরমিজি-২৪৫৯) হজরত হাসান বসরি রা: বলেন, ছয় কারণে কলব বা অন্তর নষ্ট হয়।সেগুলো হলো-

১. তওবার আশায় গোনাহ করা; ২. ইলম শিখে আমল না করা; ৩. ইখলাসের সাথে আমল না করা; ৪. আল্লাহর রিজিক খেয়ে তার শুকরিয়া আদায় না করা; ৫. আল্লাহর বণ্টনে খুশি না থাকা; ৬. মৃত লাশ দাফন করে তার থেকে উপদেশ গ্রহণ না করা।

নির্দয় ও কর্কশ হওয়াও কলবের একটি রোগ। ফুজাইল ইবনে ইয়াজ রহ: বলেন, দু’টি স্বভাবের কারণে কলব নির্দয় ও কর্কশ হয়। স্বভাব দু’টি হলো-এক. বেশি কথা বলা; দুই. বেশি খাওয়া। (হায়াতুস সালফ বাইনাল কওল ওয়াল আমল-২১৪)

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও অন্তররোগ নিরাময়ে ইসলামী ব্যবস্থা দুশ্চিন্তা ও হতাশায় মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মসমালোচনা না করায় এবং দীর্ঘ আশার ধোঁকায় পড়ে কলব নষ্ট বা রুগ্ণ হয়। মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে এমন কোনো রোগ নেই, যার কোনো চিকিৎসা আল্লাহ তায়ালা দেননি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘প্রতিটি রোগের ওষুধ রয়েছে। সুতরাং রোগে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ করা হলে মহান ও মহিয়ান আল্লাহর হুকুমে রোগ নিরাময় হয়।’ (মুসলিম, কিতাবুস সালাম-৫৫৫৩)।

মানসিক চাপসহ নানাবিধ রোগবালাই থেকে উত্তরণে ইসলামী ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর। হজরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায রহ: বলেন, অন্তররোগ নিরাময়ের ওষুধ পাঁচটি জিনিস। সেগুলো হলো-১. খুব মনোযোগসহকারে কুরআন তিলাওয়াত করা; ২. কম করে খাওয়া ও পেট খালি রাখা; ৩. কিয়ামুল লাইল করা; ৪. সাহরির সময় কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করা; ৫. নেককার লোকদের সাথে বেশি বেশি উঠাবসা করা। (হায়াতুস সালফ বাইনাল কওল ওয়াল আমল-২১৬)

এ ছাড়াও আরেকটি দাওয়া আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো ‘জিকির’। ইরশাদ হচ্ছে, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর জিকিরে অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।’ (সূরা রায়াদ-২৮) জিকির একটি ব্যাপক শব্দ। তন্মধ্যে নামাজ, দোয়া ও ইসতিগফারসহ সব ইবাদতই সাধারণত জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। তবে সর্বোত্তম জিকির হলো কুরআন পাঠ করা এবং জীবনের প্রতিটি কাজে কুরআনের বিধান অনুসরণ (জিকির) করা।

এমফিল গবেষক : আল-আজহার ইউনিভার্সিটি কায়রো, মিসর ।