কেন বারবার দ্বন্দ্বে জড়ায় গ্রিস-তুরস্ক

কেন বারবার দ্বন্দ্বে জড়ায় গ্রিস-তুরস্ক

কেন বারবার দ্বন্দ্বে জড়ায় গ্রিস-তুরস্ক

তুরস্ক এবং গ্রিস উভয়ই প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোর সদস্য৷ একত্রিত থাকতে এবং শত্রুপক্ষের হাত থেকে যে কোনো সদস্য দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্যাটো৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক মোটেও ভাল নয়৷ প্রায়ই বিবাদে জড়ায় দুটি দেশ৷

গ্রিসের প্রতিরক্ষা বাজেট দেখলে বোঝা যায় তারা কতটা চিন্তায় রয়েছে৷ বার্ষিক বাজেটে যে কোনো ন্যাটো সদস্যের চেয়ে তারা প্রতিরক্ষায় বেশি ব্যয় করে (৩.৮ শতাংশ)৷

পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়৷ তেল কিংবা গ্যাসের মতো মূল্যবান কোনো সম্পদ নিয়ে নয়, বরং সমুদ্র সীমান্ত নিয়েই দুই দেশের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব৷

১৯৯৬ সালে ইমিয়ার একটি ছোট জনবসতিহীন দ্বীপ নিয়ে দুই পক্ষ বিবাদে জড়ায়৷ একটুর জন্য তা যুদ্ধ অবধি গড়ায়নি৷ ২০২০ সালে ফের একটি ভূখণ্ড নিয়ে মারাত্মক বিবাদ শুরু হয় ৷ এবার পরের সপ্তাহে, তুরস্কের একটি জাহাজ প্রাকৃতিক গ্যাস খোঁজার জন্য রওনা দেবে৷ সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক৷

এর আগে ন্যাটো নেতারা দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিরোধ করতে বাধ্য হয়েছেন৷ ২০২০ সালে, জার্মানির প্রাক্তন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করার সময় ইইউ নেতাদের সমর্থন পেয়েছিলেন৷

এখন, পূর্ব এজিয়ানের বেশ কয়েকটি দ্বীপের উপর গ্রিসের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তুরস্ক৷ দ্বীপগুলি হলো রোডস, লেসবোস, সামোস এবং কোস৷ গ্রিসের দাবি, এই গ্রিক দ্বীপগুলির উপর দিয়ে নিয়মিত জেট ওড়ানোর অনুমতি দিয়েছে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ৷

গ্রিস তুরস্ক যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালের লুসানের চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের বর্তমান সীমানা ঠিক হয়েছিল৷ লেসবস, চিওস, সামোস এবং ইকারিয়ার দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণের ভার দেয়া হয় গ্রিসকে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৭ সালের প্যারিস চুক্তিতে ইটালি ডোডেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ গ্রিসের কাছে হস্তান্তর করে৷ কিন্তু চুক্তিতে দ্বীপগুলো নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়৷ কোনোরকম সেনা মোতায়েন করা যাবে না এমনই বলা হয়েছিল৷কিন্তু তুরস্কের পশ্চিম উপকূলে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন রেখেছে বলে দাবি করে আসছে গ্রিস৷

দুই দিকেই চরমপন্থীদের উচ্ছ্বাস!

সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা বেড়েছে৷ তুরস্কের জাতীয়তাবাদী এমএইচপি পার্টির নেতা এবং প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের একেপির জোট অংশীদার ডেভলেট বাহচেলি একটি ছবি তোলার অনুমতি দেন৷ সেই ছবিতে তার সঙ্গে থাকা মানচিত্রে পূর্ব এজিয়ানের সবথেকে বড় দ্বীপ ক্রিটকে তুরস্কের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে৷

এদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েও তুরস্কের রাজনীতিকরা চিন্তিত৷ আগামী বছর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং নতুন পার্লামেন্ট গঠনের কথা৷ এর্দোয়ান এবং তার একেপি সমর্থকরা আশঙ্কা করছেন এই নির্বাচনে বড় ধাক্কা আসতে পারে৷ মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের মানুষ নাজেহাল৷ তাই বিদেশি নীতিতে জোর দিয়ে জনগণকে তাদের প্রকৃত উদ্বেগের জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা বাড়ছে৷

এদিকে গ্রিক টিভিতে প্রাক্তন ভাইস-অ্যাডমিরাল, ইয়ানিস এগোলফপুলোস তুরস্ককে ‘শিক্ষা’ দেয়ার কথা বলেছেন৷ তার কথায়,  ‘‘তুরস্ককে প্রথমে পদক্ষেপ নিতে দিন, তারপরে তাদের যে কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে, তুর্কিরা তা ভাবতেও পারছে না৷৷’’

জার্মানি কি নিরপেক্ষ?

এই বিরোধে জার্মানির অবস্থান কী? দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক উভয় দেশে তার সাম্প্রতিকতম সফরের সময় বলেন, ‘‘গ্রিক দ্বীপপুঞ্জ গ্রিসের৷ এটি নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার কারো নেই৷’’

এরপর তুরস্কের মন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুকে অভিযোগ করেন জার্মানি আর নিরপেক্ষ নয়৷ তিনি বলেন, প্রাক্তন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের অধীনে ‘‘জার্মানি সৎ মধ্যস্থতাকারী ছিল৷ জার্মানির নীতিগুলিও ন্যায্য ছিল৷’’ কিন্তু সম্প্রতি তিনি জানান, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত, এই ভারসাম্যের অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে৷’’

এদিকে গ্রিসও মনে করে জার্মানি কোনো ন্যায্য চুক্তির কথা বললেনি৷ তুরস্কের কাছে সাবমেরিন বিক্রি সহ জার্মান অস্ত্র রপ্তানির কঠোর নিন্দা করে  গ্রিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস ডেন্ডিয়াস বলেন, ‘‘এই সাবমেরিনগুলো ভূমধ্যসাগরে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য ব্যবহার করা হবে৷ এগুলি সত্যি বিপজ্জনক৷’’

ওয়াশিংটনের ভূমিকা

জার্মানির ভূমিকা আসলে গৌণ, এ কথা মনে করে গ্রিস এবং তুরস্ক দুই দেশই ওয়াশিংটনের সমর্থন চাইছে৷

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস ওয়াশিংটনে তুরস্কের নাম না করে বলেছেন, অ্যামেরিকা যেন তাদের অস্ত্র না বিক্রি করে৷ মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষে ভাষণও দেন তিনি৷ তার বার্তা, ইউক্রেনের পরে, ন্যাটো ‘‘তার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে কোনো অস্থিরতা মেনে নেবে না৷’’ সেই সফরে মিতসোতাকিস এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়টিও চূড়ান্ত করেন৷

কিন্তু, মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে মাদ্রিদে একটি ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট বাইডেন ফাইটার জেট সরবরাহের সম্ভাবনার কথা বলেন৷ এর ফলে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের জন্য তুরস্কের সমর্থন নিশ্চিত করা যাবে৷

যদিও ইউক্রেনের যুদ্ধে তুরস্ক সরকার লাভবান হয়েছে৷  রাশিয়ার তৈরি বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কেনা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে অসন্তোষের কথা ওয়াশিংটন ভুলে গিয়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ সংকটের সময়ে ন্যাটোর সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করছেন তারা৷

সূত্র : ডয়চে ভেলে