৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা যে ভয়ানক অবস্থায় পড়েছিল

৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা যে ভয়ানক অবস্থায় পড়েছিল

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকায় মুসলমানদের ভয়ানক এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। সারা দেশেই তাদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ঘটনা বেড়ে যায়, বিভিন্ন স্থানে তারা আক্রমণেরও শিকার হয়।

এমনকি প্রশ্ন তোলা হয় আমেরিকার প্রতি তাদের আনুগত্যের ব্যাপারেও।

দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর হিসেবে, ওই বছর মুসলিম ও আরবদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ-জনিত অপরাধ বেড়ে যায় এক হাজার ৭০০ শতাংশ। ১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিমরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন।

প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে মসজিদের ওপর উঠিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও তখন ঘটেছে। তখন অনেক অঙ্গরাজ্যের মুসলিমরা প্রাণের ভয়ে তাদের দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।

৯/১১ নামে পরিচিত এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিমরা হঠাৎ করেই দেখতে পান, তারা যে দেশপ্রেমিক সেটাও তাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে।

কেভিন জেমস নামের একজন বলছিলেন, ‘মুসলিম কমিউনিটিকে তখন বলতে হয় যে, আমরাও আমেরিকান। এ এক ভয়ানক অবস্থা। তাদেরকে বলতে হয় যে, এই হামলার সাথে আমাদের ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।’

কেভিন জেমস একজন মুসলিম। ২০০১ সালে তিনি নিউ ইয়র্কের দমকল বাহিনীতে কাজ করতেন। হামলার পর অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরাই সর্বপ্রথম সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। তাদেরকে নাইন/ইলেভেনের বীর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

তিনি বলেছিলেন, ‘দমকল বাহিনীর লোকজনের মানসিকতা হচ্ছে- তুমি বিপদের দিকে ছুটে যাও, তুমি আগুনের দিকে ছুটে যাও, ছুটে গিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ো। এই প্রশিক্ষণই তাদেরকে দেয়া হয়।’

কেভিন ছিলেন ফায়ার মার্শাল। ১৯৭৭ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ২০ বছর।

দমকল বাহিনীর মুসলিম সদস্যদের নিয়ে গঠিত ইসলামিক সোসাইটির প্রেসিডেন্টও ছিলেন কেভিন। হামলার দিন তার ছুটি ছিল।

তিনি বলেন, ‘নিউ ইয়র্কে সেদিন প্রাইমারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সিটি কাউন্সিলে যাতে একজন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন সেজন্য আমি কাজ করছিলাম। তাই কাজ থেকে সেদিন ছুটি নেই। তা না হলে আমি হয়তো আগের রাতে কাজ করতাম এবং আমার কাজ নাইন/ইলেভেনের দিনেও গড়াতো। ছুটি না নিলে, বিমানগুলো যখন আঘাত হানে, আমি হয়তো তখন সেখানেই কাজ করতাম।’

সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে আমেরিকার একটি এয়ারলাইন্স- ফ্লাইট ইলেভেন বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের উত্তর টাওয়ারের ভেতরে বিধ্বস্ত হয়। সকাল ৯টা ৩ মিনিটে ছিনতাই করা আরো একটি যাত্রীবাহী বিমান- ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, ফ্লাইট ১৭৫, আছড়ে পড়ে দক্ষিণ টাওয়ারের ওপর। সেখানে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। এর ৫৬ মিনিট পর দক্ষিণ টাওয়ারটি ধসে পড়লে শহরজুড়ে প্রচুর ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে।

হামলার খবর পাওয়ার পর পরই কেভিন তার কর্মস্থলে ছুটে যান। যাত্রা শুরু করেন ঘটনাস্থলের অভিমুখে পরে যা গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ঘাঁটি ছেড়ে যাই। উঠে পড়ি একটি এলিভেটেড হাইওয়েতে, যার নাম গোয়ানেস এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তাটি সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। একটা গাড়িও ছিল না। খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছানোর জন্য আমরা ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ মাইল গতিতে ছুটছিলাম। সেখানে গিয়ে যখন পৌঁছাই, সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ধ্বংসাবশেষ। লোকজন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। আমাদের সাথে ছিল আগুন নেভানোর জন্য ১০ থেকে ২০ টনের বিশাল গাড়ি। কিন্তু ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এগুলোকে খেলনার মতো দেখাচ্ছিল। আমাদের সাথে কিছু মাস্ক ছিল। ছাই থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সেগুলো পরে নিলাম। একটু সতর্ক না হলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেতাম। একজন আফ্রিকান-আমেরিকান সহকর্মীকে দেখলাম তার মুখ পুরোপুরি সাদা- মাথা থেকে পা পর্যন্ত- সারা শরীর ধুলায় ঢেকে গেছে।’

কেভিনের দল উপলব্ধি করল ধ্বংসযজ্ঞ এতোটাই ভয়াবহ যে, তাদের তেমন কিছুই করার নেই। সেরকম যন্ত্রপাতিও তাদের ছিল না।

সেদিন কেভিনের ৩৪৩ জন সহকর্মী নিহত হয়। হামলায় মোট যত মানুষ প্রাণ হারায় এই সংখ্যা তার ১০ শতাংশেরও বেশি। হামলার পর পরই, এজন্য ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপ আল-কায়েদাকে দায়ী করা হয়। এই খবর জানার পর কেভিনের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

তিনি বলেন, ‘সেটা ছিল শারীরিক ও মানসিক দুটোই। আমি যেন চেয়ারের ভেতরে ডুবে গেলাম। সেসময় আমি নিউ ইয়র্কে আমেরিকান ও মুসলিমদের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতাম। আমরা তখন মুসলিম কমিউনিটির ধারণা বদলে দিতে শুরু করেছি। মোট আটজন মুসলিম প্রার্থী ছিল যারা সিটি কাউন্সিলের জন্য নির্বাচন করছিল। একজন দাঁড়িয়েছিল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের পদে। নির্বাচনে জয়ের দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের একটি রাজনৈতিক কণ্ঠ তৈরি হতে যাচ্ছিল। এমন একটা দিনে এই খবর শোনার পর আমার পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল।’

এই ঘটনার পর লোকজন কেভিনকে তার ধর্ম নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার এক কলিগ আমার প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সহকর্মীদের প্রাণহানির ঘটনায় তিনি বেশ রাগান্বিত ছিলেন। এতটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন এবং ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে, তিনি বলতে লাগলেন- এরকম কি কুরআনে আছে? এসব কি গ্রহণযোগ্য? আমি তখন তাকে বলি যে না, কুরআনে জীবনকে অত্যন্ত পবিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে- একজনকে হত্যা করা মানে মানবজাতিকে হত্যা করা। কুরআন কখনোই এ ধরনের কাজকে ক্ষমা করে না।’

৯/১১-এর পর গোটা আমেরিকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে, এমনকি যারা মুসলিমের মতো দেখতে, তাদের প্রতিও বিদ্বেষ-জনিত অপরাধ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। যারা হিজাব পরেন, এবং যাদের দাড়ি আছে, তাদের সাথে লোকজন গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগাতে শুরু করে। কোথাও কোথাও প্রতিশোধমূলক হামলা হয়ে ওঠে স্বাভাবিক ঘটনা।

কেভিন বলেন, ‘যাকেই মধ্যপ্রাচ্যের কিম্বা দক্ষিণ এশিয়ার লোক বলে মনে হতো, মুসলিম কিম্বা অমুসলিম হোক, তাদেরকে হামলার জন্য টার্গেট করা হতো। কিন্তু আপনি একজন হিন্দু হতে পারেন, একজন শিখ হতে পারেন, আপনার হয়তো ইসলামের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, তার পরেও আপনি হামলার শিকার হতে পারেন।’

বিভিন্ন স্থানে মুসলিম সন্দেহে শিখদের ওপরেও আক্রমণ করা হয়েছে।

১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিমরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকেই তাদের দেশপ্রেম দেখাতে বাড়িতে ও দোকানপাটে আমেরিকার পতাকা উড়িয়ে রেখেছে। তারা এটিকে বিবেচনা করেছে তাদের জীবনের রক্ষাকবচ হিসেবে।

দমকল বাহিনীর কর্মী কেভিন জেমসকে কি তার ধর্মের কারণে কোনো ধরনের বৈষম্য বা আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে?

তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো আক্রমণের মুখে পড়িনি। আমার মুখের দাড়ি সবসময় নিখুঁতভাবে কামানো থাকতো। যেসব দেখে তারা আমাকে মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, আমার সেরকম কিছুই ছিল না।’ কিন্তু কেভিন বলছেন, তার পরিচিত অনেকেই এধরনের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ইউনিফর্ম পরে থাকেন, তাহলে আপনি অনেকটাই নিরাপদ। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে অনেক রকমের সুরক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু একজন বেসামরিক লোকের বেলায় এরকম ঘটে না। আমাদের সংস্থায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক মুসলিম নারী কর্মী ছিলেন, ৯/১১-এর জন্য অনেকেই তাদের সাথে মিশতে চায়নি। পরে তাদেরকে অন্য সংস্থায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য তাদের বেতনও কমে গিয়েছিল।

মুসলমিদের ওপর এধরনের সহিংসতা ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ১৭ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনের ইসলামিক সেন্টারে একটি ভাষণ দেন। সন্ত্রাসী হামলাকারীদের সাথে যে মুসলিম আমেরিকানদের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে সেটা তিনি তার ভাষণে তুলে ধরেন।

প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন, ‘টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যা দেখেছি সেটা কোনো মুসলিম বন্ধু, নাগরিক, করদাতা এবং অন্য কোনো দেশের মুসলিম- কেউই তা বিশ্বাস করতে পারেনি। তারা স্তম্ভিত হয়ে গেছে। এধরনের কাজ, এবং নিরীহ লোকজনের বিরুদ্ধে সহিংসতা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের লঙ্ঘন। আমেরিকার নাগরিকদের জন্য এটা বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

কেভিন মনে করেন প্রেসিডেন্টের এই ভাষণ দেয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বুশের ভক্ত ছিলাম না। তাকে আমি ভোটও দেইনি। কিন্তু আমি মনে করি, সময়ের প্রয়োজনে তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যেটা তার বক্তব্যে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আসা এসব কথা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী।’

এর কয়েক দিন পরেই বুশ প্রশাসন দেশপ্রেম আইন উত্থাপন করে। এই আইনটি সরকারকে আমেরিকানদের ওপর নজর রাখার ক্ষমতা দেয়। নিউ ইয়র্কের পুলিশ বাহিনী মুসলিম কমিউনিটির ওপর নজরদারি করার জন্য একটি টিম গঠন করে। কেভিন মনে করেন, ওই উদ্যোগ মুসলিম আমেরিকানদের সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পর্ককে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ এক মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নজর রাখার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর ছিল। ব্রুকলিনের কেন্দ্রে পাকিস্তানিসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক লোক বসবাস করে। মধ্যপ্রাচ্যেরও অনেকে আছেন। অনেক মসজিদও আছে। পুলিশ কর্মকর্তারা সেখানে প্রচুর লোকজনকে গ্রেফতার করেছে।’

৯/১১-এর প্রায় এক বছর পর দমকল বাহিনীর কাজ ছেড়ে দেন কেভিন জেমস। এর পর তিনি নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। কাজ করেন ৯/১১-এর পর মানুষের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে।

তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম কমিউনিটিকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য কথাবার্তার প্রয়োজন। কিন্তু ৯/১১ সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল।

সূত্র : বিবিসি