পুরস্কারে বডিবিল্ডারের লাথির ভিডিও ভাইরাল, কী ঘটেছিল সেদিন

পুরস্কারে বডিবিল্ডারের লাথির ভিডিও ভাইরাল, কী ঘটেছিল সেদিন

পুরস্কারে বডিবিল্ডারের লাথির ভিডিও ভাইরাল, কী ঘটেছিল সেদিন

বাংলাদেশে একটি বডিবিল্ডিং বা শরীর গঠন প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পুরস্কারে লাথি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।ওই প্রতিযোগিতার একটি ক্যাটেগরিতে দ্বিতীয় হওয়া জাহিদ হাসান পুরস্কার নিয়ে নেমে আসার পর মঞ্চের সামনে সেটা লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলেন।

বডিবিল্ডার জাহিদ হাসান অভিযোগ করেছেন, ফেডারেশনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাকে প্রথম স্থান দেয়া হয়নি। তবে এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে ফেডারেশন।তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে ফেডারেশন।তবে তিনি জানিয়েছেন, এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।তবে সামাজিক মাধ্যমে সেদিনের ঘটনার ভাইরাল ভিডিও নিয়ে অনেকেই পক্ষে ও বিপক্ষে নানারকম মন্তব্য করছেন।

শুক্রবার কী ঘটেছিল ফেডারেশনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে

বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশন দেশজুড়ে বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল এই মাসের শুরুতে।সেখানে ছয়শো দুইজন বেশি প্রতিযোগী অংশ নেয়।গত ২৩শে ডিসেম্বর ছিল সেই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সেখানে পুরুষদের বডি ফিজিক ক্যাটেগরিতে দ্বিতীয় হয়েছিলেন বডিবিল্ডার জাহিদ হাসান শুভ। তিনি এর আগে চারবার এ ধরনের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। 

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, পুরস্কারের পদক এবং স্পন্সর কোম্পানির দেয়া একটি ব্লেন্ডার তুলে দেয়ার পর তিনি মাইকে কিছু বলতে চান।কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতি তাকে কিছু বলতে না দিয়ে হাত দেখিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলেন।

বডিবিল্ডার জাহিদ হাসান শুভ মঞ্চ থেকে নেমে সামনে দিয়ে আসার সময় হাতের ব্লেন্ডারে লাথি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেন। এরপর তিনি আবারো সেটিতে লাথি মেরে দূরে ফেলে দেন।

জাহিদ হাসান শুভ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আমি তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাথি মেরেছি। এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। তিনি বলছেন, ‘ওনারা সরাসরি অবিচার করেছে। সাজানো একটি খেলা প্রেজেন্টেশন করেছেন।  যেকোনো খেলায় বিচারের একটা নিয়ম থাকে। কিন্তু এখানে প্লেয়ারের স্কোর দেখার কোন উপায় নেই। যাই হোক, যখন স্টেজ থেকে আমি প্রাইজটা নিলাম, আমি ওনাকে (সেক্রেটারি) বললাম, আমাকে মাইকটা দেন। তিনি আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন।‘’

 ‘’ভিডিওতে বডির কন্ডিশনিংটা দেখবেন। মেন ফিজিকে বডির যে আদর্শ  কন্ডিশন থাকে, যা যা দেখা হয়.... তার দেহ যদি আমার চেয়ে ভালো হয় কিন্তু কন্ডিশন ভালো না হয়, তাকে প্রাইজ দেয়াটা কতটুকু ন্যায্য? আপনি তো দেখেও বুঝতে পারবেন, দুইজনের মধ্যে কোন বডিটা সুন্দর’’ তিনি বলছেন। তিনি দাবি করেছেন, অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে তাকে প্রথম হতে দেয়া হয়নি। সেখানে পুরোপুরি অবিচার হয়েছে।

‘’আমি মনে করি, হান্ডেড পার্সেন্ট আমি চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু একদম ভুয়া জাজমেন্ট করেছে। দুই নাম্বারি করে আমাকে সেকেন্ড প্লেস দিয়েছে। তারপরেও মেনে নিলাম। কিন্তু আমাকে স্টেজে যে খারাপ আচরণ করেছে, এগুলো কখনো শোভনীয় না। ওনাদের দুর্নীতি আমি একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। তাই আমার আর কোন উপায় ছিল না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাথি না দিয়ে আর পারি নাই। আমি তখন চিন্তাও করতে পারি নাই, আমার সাথে কি হচ্ছে এটা?''

তিনি দাবি করেন, তার এই শরীর গঠনের পেছনে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেই সঙ্গে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে।তবে ওই আয়োজনে কোন দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ শরীর গঠন ফেডারেশনের মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম খান নাঈম।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’এর আগে চারবার সে ফার্স্ট হয়েছে, এবার সেকেন্ড হয়েছে। সেই সেকেন্ড হওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না। ‘’তিনি জানান, ১১ বিচারকের একটি প্যানেলের মাধ্যমে বিচার কাজ হয়। সেই বিচারকরা যে রায় দেন, সেটার সম্মিলিত পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে।

‘’না পেরে স্টেজে গিয়ে সে মাইক চেয়েছে। তখন আমাদের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ভাই বলছেন, ...আপনি ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। তখন সে ওই কাজ করেছে।..এটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি ছিল। আমরাও বিপদে পড়ে গিয়েছি।  সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বডিবিল্ডিং ইতিহাসে এরকম আর কখনো হয়নি।‘’‘’এর ফলে আমাদের বডিবিল্ডিংটাও একটা প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল,’’ তিনি বলছেন।

তার দাবি, ‘’অনেকে ভিডিও বা ছবিতে তুলনা করেন, এর বডি ভালো, ওর বডি ভালো। আসলে শুধু বডি দেখে সব কিছু হয় না।  কিন্তু বিচারকরা শুধু এভাবে দেখেন না। এজের প্রপরশন, বেলেন্স ডেভেলপমেন্ট, সিমেট্রি, ঘনত্ব, স্টেজ প্রেজেন্টেশন- সব মিলিয়ে জাজমেন্ট করা হয়। তার কাফ ম্যাসল কেমন আছে, থাই মাসল কেমন আছে। ১১ জন জাজের কারও মতে হয়তো প্রথম, কারও মতে হয়তো দ্বিতীয়, এসব ক্যালকুলেশন করেই রেজাল্ট দেয়া হয়।‘’

তিনি বলছেন, ওই  আচরণ না করে তিনি যদি ফেডারেশনে লিখিতভাবে অভিযোগ দিতেন বা ব্যাখ্যা জানতে চাইতেন, তখন নিয়ম মেনেই তারা সেটা যাচাই করে দেখতেন।কিন্তু জাহিদ হাসান শুভ বলছেন, ‘’আপনি আমাকে মানুষ ভাববেন না, আামাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেবেন, আর আমি লিখিত দেবো? ওনারা চুরি করেছেন, আমি রিয়্যাক্ট করেছি। আমার রাইট আছে।‘’

পুরো প্রতিযোগিতায় ৬০২ জন অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রতিটি ক্যাটেগরিতে ৬ জন করে মোট ১৩টা ক্যাটেগরিতে ৭৮ জন পুরস্কার পেয়েছে।প্রতিযোগিতায় ১৩টি ক্যাটেগরিতে যারা প্রথম হয়েছে, তাদের সবাইকে ৫০ হাজার করে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তিনি এবং অন্য সবাই পদক ও স্পন্সর কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি করে ব্লেন্ডার পেয়েছেন।

বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ফেডারেশনের, আন্দোলন চালিয়ে যাবেন শুভ

শুক্রবারের ওই ঘটনায় ফেডারেশনের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জাহিদ হাসানকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।মি. নাঈম বলছেন, ‘’এটার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ না করলে পরবর্তীতে একটা বাজে উদাহরণ তৈরি হয়ে যায়। এর মধ্যেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে গেছে।‘’ফেডারেশনের পাতায় সেদিন পুরস্কারে লাথি মারা এবং পরবর্তীতে অনুষ্ঠানস্থলে বডিবিল্ডার জাহিদ হাসানের অশালীন অঙ্গভঙ্গির ভিডিও পোস্ট করে লিখেছে, ‘রিজন অফ এক্সপেল ফ্রম বিএবিবিএফ’।

তবে ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিজের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাহিদ হাসান।তিনি বলছেন, ‘’ফাইন, ওনারা কাগজ কলমে বহিষ্কার করে দিছে। কিন্তু আমার (ফেসবুক) পেইজে  দেখেন, সেখানে মানুষ কি কমেন্ট করতেছে। দেখুন মানুষ কিভাবে দেখছে? আমি গোল্ড মেডালিস্ট, আমার সাথে নাটক চলবে না। আইনি ব্যবস্থা হবে। দেশে যদি আইন থেকে থাকে, যে পর্যন্ত আমি আমার অধিকার না পাবো, এই আন্দোলন চালিয়ে যাবো।‘’

সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা

জাহিদ হাসানের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এভাবে লাথি মারা ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। অনেকে তার পক্ষে যেমন বক্তব্য দিচ্ছেন, অনেকে আবার এই আচরণের সমালোচনাও করেছেন।রহমত রিসান লিখেছেন, 'এভাবেই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচিত জবাব। স্যালুট ভাই। হাজারো প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে এই দেশ থেকে।'সাকিব আহমেদ রনি মন্তব্য করেছেন, 'চমৎকার হয়েছে। বাংলাদেশে ফুটবলের অপমৃত্যু ঘটেছে। হকির অপমৃত্যু ঘটেছে। শুটিং এর অপমৃত্যু ঘটেছে। এবার বডিবিল্ডিংয়ের পালা।'খালিদ মাহমুদ খান মন্তব্য করেছেন,' ঠিকই আছে, বেয়াদবের দরকার আছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে তো তেমন প্রাইজমানি নাই, তার উপরে সম্মান টাও কেড়ে নেয়।'

রাজেশ লোধ লিখেছেন, 'শুভ যে কাজটা করেছে তা ঠিক করে নাই। প্রতিবাদ অন্যভাবে করতে পারতো। কিন্তু কথা হচ্ছে অন্যভাবে করলে তা নিয়ে কোনো কথা হতো না এমনকি মিডিয়ার সামনেও আসতো না। আমি মনে করি সে যে কাজটা করেছে সে শত শত মানুষের হয়ে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু দিন শেষে ক্ষতিটুকু শুধুমাত্র তারই হয়েছে।'রুবায়েত করিম মন্তব্য করেছেন, 'এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা তখনই ঘটে যখন‌ আপনি স্টেজে জিতার আগেই ব্যাকস্টেজে জিতে বসে থাকেন। জাজরা চোর হলে আগের দুই বছর কিন্তু যিনি লাথি মারছে উনিই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। দিন শেষে কথা হলো স্পোর্টসম্যানশীপ থাকতে হবে।'

সূত্র : বিবিসি