ফেন্টানিল : এক প্রাণঘাতী মাদকের ধ্বংসযজ্ঞের শুরু যেখান থেকে

ফেন্টানিল : এক প্রাণঘাতী মাদকের ধ্বংসযজ্ঞের শুরু যেখান থেকে

প্যারামেডিকরা সান ডিয়েগোতে ফেনটানিল ওভারডোজের শিকার এক নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে

ফেন্টানিল একটি প্রাণঘাতী সিনথেটিক মাদক, এটি হেরোইনের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই মাদকের কারণে এমন হারে আমেরিকানদের মৃত্যু ঘটছে যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার ন্যালোক্সোন নামে এটি ঔষধ প্রেসিক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি করা যাবে বলে অনুমোদন দিয়েছে- কারণ এই ঔষধ দিয়ে ফেন্টানিলের ওভারডোজের চিকিৎসা করা যায়। ফেন্টানিলের এই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের শুরু কিন্তু আরও অনেক দক্ষিণ থেকে।ফেন্টানিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একেবারে সন্মুখ রণক্ষেত্র মানজানিলো।

এটি মেক্সিকোর প্রশান্ত মহাসাগর তীরের এক সুন্দর শহর। ১৯৭০ এর দশকে হলিউডের একটি চলচ্চিত্র এই শহরকে বেশ খ্যাতি এনে দিয়েছিল। সেই ছবিতে অভিনেত্রী বো ডেরেককে শহরের বালুকাময় সৈকত ধরে দৌঁড়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু এই শহর এখন মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বড় অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর হানাহানির কেন্দ্রে।মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় বন্দর এই মানজানিলোতে। এটি লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর- গত বছর সারা পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫ লাখ কন্টেইনার এই বন্দরে এসেছে।

এই বন্দর দিয়ে সব ধরণের মালামাল আসে-যায়। এর মধ্যে সিনথেটিক মাদক ফেন্টানিল তৈরিতে দরকার হয় এমন রাসায়নিকও আছে। এসব রাসায়নিক আসে মূলত চীন এবং ভারত থেকে।বিশ্বে সংগঠিত অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যবসা কিন্তু এখন এই ফেন্টানিল মাদক নিয়েই। ফলে এই বন্দরটিকে ঘিরেই এখন কোলিমা রাজ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তপাত এবং সহিংসতা ঘটছে।

মেক্সিকোর এই ছোট্ট পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যে ২০২২ সালে মাথাপিছু হারে সবচেয়ে বেশি খুনোখুনি হয়েছে। সেখানে সিনালোয়া এবং জালিস্কো নিউ জেনারেশন- এই দুটি বড় মাদক অপরাধী গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে।“সম্প্রতি আমরা প্রপিওনিয়ল ক্লোরাইডের একটি চালান আটক করি, এটি ফেন্টানিল তৈরিতে দরকার হয়। মানজানিলোতো ফেন্টানিল তৈরির আরও যেসব রাসায়নিক আসে, এটি তার একটি,” বলছিলেন বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নৌবাহিনীর এক কমান্ডার, যিনি নিরাপত্তার খাতিরে তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।

মেক্সিকোর সরকার ২০২১ সালে নৌবাহিনীকে সব সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছিল। এসব বন্দরকে ঘিরে যে দুর্নীতি, যার সঙ্গে জড়িত থেকে সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, সেটা বন্ধ করাই ছিল লক্ষ্য।এখন মানজানিলো বন্দরে যারা কাজ করে, তাদের প্রত্যেকের ওপর নজরদারির জন্য এক অত্যাধুনিক ব্যবস্থা চালু আছে। বিশেষ করে রাসায়নিকের ব্যবসায় যারা জড়িত, তাদের ওপর চোখ রাখার জন্য। কিন্তু এখানে অন্য একটি বাধা আছে- কিছু রাসায়নিক এগ্রো-কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যবহৃত হয় বৈধভাবেই।

এর মানে হচ্ছে, এখন কাগজপত্র আরও কঠোরভাবে যাচাই করা হয় এবং নৌবাহিনীর দলগুলো বন্দরে আসা রাসায়নিকের চালানগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে, যে জিনিসের কথা বলে আমদানি করা হচ্ছে আসলে সেগুলো সেই রাসায়নিক কিনা।তাদের একটি প্রশিক্ষিত কুকুরও আছে, এটি একটি বেলজিয়ান শেপাার্ড। মার্কিন দূতাবাস এটি উপহার হিসেবে দিয়েছে। এই কুকুরটি গন্ধ শুঁকে ফেন্টানিল পাউডার বা পিল খুঁজে বের করতে পারে, এমনকি ফেন্টানিল তৈরির উপাদানও।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর সম্প্রতি দাবি করেন যে মেক্সিকোতে ফেন্টানিল তৈরি হয় না, এই মাদক তার দেশে ব্যবহারও হয় না। তার এই মন্তব্য তখন সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। কিন্তু ফেন্টানিল তৈরির অনেক অস্থায়ী কারখানা মেক্সিকো সিটি এবং উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য নিউভো লিওন এবং সাইনালোয়াতে খুঁজে পাওয়া গেছে, এগুলো পরে বন্ধ করে দেয়া হয়।বাহা ক্যালিফোর্নিয়ার টিহুয়ানা শহরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গত বছর দুটি বাড়িতে অভিযান চালায় এবং বিপুল পরিমাণ ফেন্টানিল পিল এবং পাউডার পায়। সেখানে ট্যাবলেট তৈরির একটি হাইড্রলিক যন্ত্রও ছিল।

টিহুয়ানা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত লাগোয়া এক বিশৃঙ্খল এবং নিষ্ঠুর শহর। এটি ফেন্টানিল মাদকের কেন্দ্র বা ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে পরিণত হয়েছে। এই শহর হয়েই উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মাদকের চালান যায়, আবার স্থানীয় ব্যবহারের মাদকও এখান থেকে সরবরাহ হয়।“এই মাদক সবাইকে খুন করছে- আমার সব বন্ধুকে,” বলছেন স্মাইলি। তিনি নিজেও ফেন্টানিলে আসক্ত, গৃহহীন, থাকেন রাস্তায়।

টিহুয়ানার খাল বরাবর শত শত মানুষ রাস্তার ধারে থাকে-ঘুমায়। কংক্রিটের এই চ্যানেলটি টিহুয়ানা শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থল দিয়ে গেছে। এদের অনেকেই মাদক ব্যবহারকারী। আর যুক্তরাষ্ট্রে যেটা প্রায়শই দেখা যায়, এখানেও যারা মাত্রাতিরিক্ত মাদক নেয়, তারা হয়তো জানেও না যে তারা ফেন্টানিল নিচ্ছে।ফেন্টানিল এতটাই মারাত্মক যে, সামান্য মাত্রায় নিলেও মৃত্যু ঘটতে পারে। মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের দুদিকেই ফেন্টানিল মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে কোকেইন, হেরোইন এবং মেথাম্ফেটামিনের সঙ্গে।

স্মাইলির বিশ্বাস, ২০ জনের বেশি মানুষকে তিনি এই মাদককে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করতে দেখেছেন। পরে তিনি তাদের ন্যালোক্সোন ব্যবহার করে বাঁচিয়ে তুলেছেন। ওপিয়ডের ওভারডোজের কারণে কারও অবস্থা আশংকাজনক হয়ে পড়লে তাকে এই মেডিকেটেড স্প্রে দিয়ে সুস্থ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যালোক্সোন এখন হরহামেশা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মেক্সিকোতে এটি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিনতে পাওয়া যায় না। স্মাইলি তার ন্যালোক্সোনের সরবরাহ পান একটি স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে।

তবে ফেন্টানিলের শিকার কেবল গৃহহীন মানুষ নন। ২০২২ সালে টিহুয়ানা শহরে প্রতি মাসে গড়ে ৬০ জন ফেন্টানিলের মাত্রাতিরিক্ত ডোজের শিকার হয়, তখন তাদের বাঁচাতে মেক্সিকান রেডক্রসকে ডাকতে হয়। এদের মধ্যে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ ছিল। এর মধ্যে মাদক গ্রহণের অনেক অনুষ্ঠানও ছিল, যেখানে এরকম ওভারডোজের ঘটনা ঘটেছে। তবে কত মানুষ ফেন্টানিল নিয়ে মারা গেছে তা জানা যায়নি, কারণ মেক্সিকোতে এধরণের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয় না।

যে সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে- টিহুয়ানায় তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলে। প্রতিটি ব্লক বা রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন ভিন্ন অপরাধী চক্র। মাদক বিক্রির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বেশ সহিংস এবং রক্তাক্ত লড়াই চলে। কেবল জানুয়ারি মাসে টিহুয়ানায় ১৫৬টি খুন হয়েছে- অথচ এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র বিশ লাখ।টিহুয়ানার এই নিরাপত্তাহীনতার পেছনে ফেন্টানিলের বড় অবদান আছে। ফেন্টানিল বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করা যায়। ধারণা করা হয়, হেরোইন তৈরির যে খরচ, তার একশো ভাগের এক ভাগ খরচ লাগে ফেন্টানিল তৈরিতে।

মেক্সিকোর অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে এখন আর গ্রামাঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখার দরকার হয় না, কারণ তাদের এখন আর পপি চাষের জন্য জমির দরকার নেই। তাদের এখন দরকার রাসায়নিক, আর দরকার এমন কাউকে, যে জানে কিভাবে রাসায়নিক মিশিয়ে ফেন্টানিল তৈরি করতে হয়। আর ফেন্টানিল যেহেতু খুবই শক্তিশালী মাদক, তাই অল্প বিক্রি করেও এ থেকে অনেক মুনাফা করা যায়। আর যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করতে পারলে তো কথাই নেই, সেখানে এর দাম বেড়ে যায় দশগুণ।“আমি খুব আঁটোসাঁটো একধরণের অন্তর্বাস পরতাম, যেটি পরলে আপনাকে খুব স্লিম দেখাবে, এরপর আমি এর ভেতরে ফেন্টানিল ট্যাবলেট লুকিয়ে রাখতাম”, বলছিলেন এপ্রিল স্প্রিং কেলি। যুক্তরাষ্ট্রের এক ফেডারেল কারাগারের ভেতর থেকে তিনি বিবিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি কোন কোন সময় গাড়িতে করেও ফেন্টানিল পাচার করেছেন।

এপ্রিল স্প্রিং কেলিকে এখন মাদক পাচারের অভিযোগে দীর্ঘ সাজা খাটতে হচ্ছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে ২০১৮ সালে তিনি টিহুয়ানা থেকে প্রায় ৫ লাখ ফেন্টানিল পিল এবং অন্যান্য মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন।আরও অনেক আমেরিকানের মতো তিনি নিজেও বেদনানাশক ওপিয়ডে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এরপর যখন প্রেসক্রিপশনে এসব ওপিয়ড পাওয়া কঠিন হয়ে পড়লো, তখন তিনি মেক্সিকান অপরাধী চক্রগুলোর তৈরি হেরোইনের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

তার এই মাদকাসক্তির খরচ যোগাতে তিনি টিহুয়ানায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেন। এরপর সেখান থেকে সীমান্তের অপর দিকে স্যান ডিয়েগোতে সংগঠিত অপরাধী চক্রগুলোর কাছে ফেন্টানিল নেয়া শুরু করেন।গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ ফেন্টানিলের মতো সিনথেটিক ওপিয়ডের ওভারডোজে মারা গেছে। এপ্রিল স্প্রিং কেলি এখন তীব্র অনুশোচনায় ভুগছেন- কারণ তার পাচার করা ফেন্টানিলের সঙ্গে একটি শিশুর মৃত্যুর সম্পর্ক আছে।

“এটা খুবই ভয়ংকর। এই ঘটনায় যে আমার সম্পর্ক ছিল, সেজন্যে আমি নিজেকে ঘৃণা করি”, বলছিলেন তিনি।যুক্তরাষ্ট্রে যত ফেন্টানিল আটক করা হয়, তার অর্ধেকই ধরা পড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সীমান্তে। এপ্রিল স্প্রিং কেলি ধরা পড়েছিলেন স্যান ইসিডরো সীমান্ত বন্দরে। প্রতিদিন এই সীমান্তপথে পারাপার হয় এক লাখ বিশ হাজার মানুষ।টিহুয়ানা থেকে এই সীমান্ত বন্দর পেরুলে সেখান থেকে স্যান ডিয়েগো শহর কেন্দ্রে ট্রামে যেতে সময় লাগে মাত্র ৪০ মিনিট।

কেবল ২০২১ সালেই ফেন্টানিলের কারণে এই শহরে ৮১৪ জন মারা গেছে। এর মানে হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে সেখানে ১৫ টি মারাত্মক ওভারডোজের ঘটনা ঘটেছে। এই স্যান ডিয়েগোর জনসংখ্যা হচ্ছে তিরিশ লাখ।“গত কয়েক বছর ধরে এত বেশি মানুষ মারা গেছে যে, আমরা যদি এদের সবার ময়না তদন্ত করতে চাইতাম, আমরা কুল পেতাম না। সবার ময়না তদন্ত করতে হলে আমাদের আরও প্যাথোলজিস্ট নিয়োগ করতে হতো,” বলছিলেন স্যান ডিয়েগো কাউন্টির প্রধান মেডিকেল এক্সামিনার ড. স্টিফেন ক্যাম্পম্যান।

সূত্র : বিবিসি