দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম নিয়ে চীন ও আমেরিকার দড়ি টানাটানি

দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম নিয়ে চীন ও আমেরিকার দড়ি টানাটানি

দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম নিয়ে চীন ও আমেরিকার দড়ি টানাটানি

বিশ্বের মোট লিথিয়ামের অর্ধেকেরও বেশি পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি দেশে – আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলি।এই তিনটি দেশের লিথিয়ামের বাজারের ওপর অনেক দিন ধরেই শুধু ব্যবসায়ীদেরই নয়, অনেক দেশের সরকারেরও তীক্ষ্ণ নজর।নানা ধরণের ব্যাটারি, এমনকি গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতেও লিথিয়াম প্রধান উপকরণ।ফলে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিত করতে তৎপর।দিনে দিনে আরও অনেক দেশও লিথিয়ামের জন্য লাইন দিচ্ছে।

“জ্বালানির বাজার রূপান্তরিত হচ্ছে, এবং সেই সাথে প্রধান শক্তিধর দেশগুলো বিকল্প জ্বালানির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।আর সেই প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে লাতিন আমেরিকা,” বলেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের লাতিন আমেরিকা বিভাগের পরিচালক বেনজামিন জেদান।“যুক্তরাষ্ট্র এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে এবং চীনের তৎপরতা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত,” তিনি বলেন।

চীনা কোম্পানিগুলো হোয়াইট গোল্ড (শ্বেত সোনা) নামে খ্যাত লিথিয়ামের মজুদ নিশ্চিত করতে অনেক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।তারা বিশেষভাবে নজর দিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায় কারণ এই ধাতুর সবচেয়ে বড় মজুদ সেখানেই।যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরীপ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বলিভিয়ায় বিভিন্ন খনিতে লিথিয়ামের মজুদ ২১ মিলিয়ন টনের মত। আর্জেন্টিনার রয়েছে ১৯.৩ মিলিয়ন টন এবং চিলির মজুদ ৯.৬ মিলিয়ন টন।

মেক্সিকোর মজুদ যদিও মাত্র ১.৭ মিলিয়ন টন, কিন্তু লিথিয়াম ইস্যুতে দেশটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের পাশে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির বেশ বড় একটি কেন্দ্র হয়ে উঠছে মেক্সিকো।টেসলা এবং বিএমডব্লিউ সম্প্রতি ঘোষণা করেছে তারা মেক্সিকোতে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করবে।

চিলির পরিকল্পনা

অস্ট্রেলিয়ার পর চিলি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লিথিয়াম উৎপাদনকারী দেশ।এখন পর্যন্ত সেখানে এই সম্পদ বেসরকারি কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিচ সম্প্রতি নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। তিনি চাইছেন এই হোয়াইট গোল্ডের মুনাফা যতটা সম্ভব দেশেই রেখে দিতে হবে।

চিলির প্রেসিডেন্ট চাইছেন কাঁচামাল হিসাবে লিথিয়াম বিক্রির বদলে তা দিয়ে ইলেকট্রিক ব্যাটারির মত পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি করতে যাতে মুনাফার পরিমাণ বাড়ে।সেজন্য তিনি বেসরকারি খাত ও সরকারের মধ্যে যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে চাইছেন যেখানে লিথিয়ামের মত প্রাকৃতিক সম্পদ ভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করা যাবে।কিন্তু এই প্রচেষ্টা সহজ নয় কারণ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশ এই সম্পদে হাত দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।

চীনকে নিয়ে আমেরিকার উদ্বেগ

মার্কিন সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কম্যান্ডের প্রধান জেনারেল ল্যরা রিচার্ডসন সম্প্রতি সতর্ক করেছেন যে চীন “লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয় অঞ্চলে তাদের অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, প্রযুক্তিগত, তথ্যপ্রবাহ এবং সামরিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।“মার্চে মার্কিন কংগ্রেসের সেনাবাহিনী বিষয়ক কমিটির সামনে এক শুনানিতে তিনি একথা বলেন।

“এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং তার সুযোগ নিতে আমাদের বৈরি কিছু পক্ষ যেভাবে অসাধু তৎপরতা চালাচ্ছে তাতে আমি উদ্বিগ্ন।তারা বিনিয়োগের ভান করছে, কিন্তু আসলে তারা খনি থেকে ধাতু তুলে নিয়ে যাচ্ছে।“লিথিয়াম সমৃদ্ধ আর্জেন্টিনা, চিলি এবং বলিভিয়ার প্রসঙ্গ তুলে মার্কিন ঐ জেনারেল বলেন, “চীন সেখানকার লিথিয়ামে ভাগ বসাতে খুবই আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে এবং তারা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।“

চীন কী বলছে

যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জ্বালানি নির্ভরতার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।চীনও সেই দৌড়ে এগিয়ে এবং গত কয়েকবছর ধরে তারা সেই লক্ষ্যে লিথিয়ামসহ প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশেষ তৎপর।

জানুয়ারি মাসে চীনা সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার সাথে এক সাক্ষাৎকারে চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী ওয়াং গুয়াংহুয়া বলেন, “বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের জন্য চীন অন্য দেশের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।ফলে বিশ্ব পরিস্থিতিতে কোন রদবদল হলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।”

চীনা সরকার ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাদের জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ পরিকল্পনায় ২৪টি খনিজ সম্পদকে “কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করে।সেগুলোর মধ্যে রয়েছে – লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, নিকেল, কোবাল্ট, লিথিয়াম এবং রেয়ার আর্থ।পরিকল্পনায় বলা হয় চীনের “অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক এসব খনিজ সম্পদ অত্যন্ত জরুরী।“

চীনা বিনিয়োগে নাটকীয় বৃদ্ধি

দক্ষিণ আমেরিকার খনিতে চীন বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে।আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলির মত দেশগুলোও চীনের প্রযুক্তি এবং পূঁজির সুবিধা নিতে খুবই উৎসাহী। তারা মনে করছে এতে তাদের স্থানীয় শিল্পেরও উন্নয়ন হবে।এ বছরের প্রথম তিন মাসে এই তিনটি দেশে চীনা কোম্পানিগুলো খুবই উচ্চাভিলাষী কিছু বিনিয়োগ চুক্তি সই করেছে।

চীনের তিনটি কোম্পানি – সিএটিএল, বিআরইউএনপি এবং সিএমও – বলিভিয়ার লিথিয়াম উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।এই পরিসংখ্যান দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিল।চীনের চেরি অটোমোবাইল কোম্পানি আর্জেন্টিনায় ইলেকট্রিক কার তৈরির জন্য ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।

চিলিতে কয়েকটি চীনা কোম্পানি একটি লিথিয়াম শিল্প পার্ক তৈরির জন্য বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।আর্জেন্টিনায় লিথিয়াম খনির উন্নয়নেও চীন খুবই তৎপর। দুই সরকারের মধ্যে এখন সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ।২০২২ সালে আর্জেন্টিনার তিনটি এলাকায় দুই দেশ যৌথভাবে কমপক্ষে নয়টি বিনিয়োগ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে।

প্রযুক্তিগত এবং ভূ-রাজনৈতিক রেষারেষি

গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ আমেরিকা বিষয়ক গবেষক পেপ ঝাং বলছেন,” যুক্তরাষ্ট্র এখন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ দ্রব্য এবং গ্রিন প্রযুক্তির সাপ্লাই চেনে তাদের অবস্থান শক্ত করতে উদগ্রীব।“তার অর্থ, বিবিসিকে বলেন মি ঝাং, “প্রযুক্তি এবং ভূ-রাজনীতি নিয়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে রেষারেষিতে লিথিয়াম এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য হয়ে উঠেছে।”এবং চীন এই প্রতিযোগিতায় একেবারেই পিছিয়ে নেই।

মি ঝাংয়ের হিসাবে, এ বছর দক্ষিণ আমেরিকার খনিজ সম্পদ উন্নয়নে চীনা বিনিয়োগ বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে। ২০২১ সালে যেখানে চীনের বাৎসরিক বিনিয়োগ ছিল ১১০ কোটি ডলার সেখানে এবছর চীন ১৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।“এক জানুয়ারি মাসেই তিনিটি চীনা কোম্পানি বলিভিয়ায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।“

জাতীয় নিরাপত্তা

আমেরিকাও খোলাখুলি বলছে কৌশলগত কারণে খনিজ দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।“অনেক আধুনিক প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ দ্রব্য প্রয়োজন, এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এগুলো দরকার,” গত বছর এক বিবৃতিতে বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

কম্পিউটার থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, ব্যাটারি, সোলার প্যানেল বা উইন্ড টারবাইনের মত পণ্যের উৎপাদনে লিথিয়াম, কোবাল্ট বা রেয়ার আর্থের মত খনিজ দ্রব্য প্রয়োজন।মি. বাইডেন বলেন এসব খনিজ দ্রব্যের চাহিদা আগামী কয়েক দশকে চারশো থেকে ছশো শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, লিথিয়াম এবং গ্রাফাইটের চাহিদা বাড়বে চার হাজার গুণ।

ওয়াশিংটন-বেইজিং দড়ি টানাটানি

“চীন লাতিন আমেরিকায় ব্যাটারি তৈরিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, ফলে তারা (আমেরিকার চেয়ে) সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে,” বলেন গবেষক বেনজামিন জেদান।

“যুক্তরাষ্ট্র মূলত চেষ্টা করছে গ্রিন প্রযুক্তি তৈরিতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করতে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসতে।“ফলে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর কাছে চীনের প্রস্তাব অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। কারণ তারা চাইছে কাঁচামাল না বেঁচে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করতে।“আমেরিকা এখন সেটি বুঝে তারাও চীনের পথ নিতে চাইছে,” বলেছেন মি. জেদান। “ফলে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছে দক্ষিণ আমেরিকা।“

সূত্র : বিবিসি