ভূমিকম্প সম্পর্কে নবীজির সাবধানবাণী

ভূমিকম্প সম্পর্কে নবীজির সাবধানবাণী

প্রতীকি ছবি

ভূমিকম্প মহান আল্লাহর অসীম শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। যেদিন মহাবিশ্বের আয়ু ফুরিয়ে যাবে, সেদিন ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে পুরো সৃষ্টিজগৎ ধ্বংস করে দেওয়া হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলো এরই ছোট নমুনামাত্র। অতীতে অনেক জাতিকে অবাধ্যতার শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্প দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

ভূমিকম্প তেমনই এক নিদর্শন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও, ‘আল্লাহ তোমাদের উপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’ (সুরা আনআম: ৬৫)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৫৯)

সাধারণত মানুষকে পরীক্ষা করা বা গুনাহ মাফ করার জন্য বিভিন্ন দুর্যোগ মসিবত নেমে আসলেও মানুষের গুনাহের শাস্তি হিসেবেও আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিভিন্ন দুর্যোগের মুখোমুখি করেন। ভূমিকম্প অন্যতম দুর্যোগ। হাদিসে আছে, পৃথিবীতে যখন ব্যাপক হারে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অন্যায়-অবিচার ও বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে, তখন এ জাতি ভূমিকম্পের মুখোমুখি হবে। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথরবর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহ রাসুল। তিনি বলেন, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদপানে সয়লাব হবে। (তিরমিজি: ২২১২)

আর ভূমিকম্পের বিভীষিকা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে কোরআনের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা তা তুলে ধরে বলেন, ‘হে মানব সকল, তোমরা ভয় কর তোমাদের রবকে। নিশ্চয়ই কেয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে একটা মারাত্মক ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, স্তন্যদায়ী মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে আর সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। দৃশ্যত মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, আসলে তারা নেশাগ্রস্ত হবে না। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ (সুরা হজ: ১-২)

সালেহ ও শোয়াইব (আ.)-এর সম্প্রদায় তাদের নবীদের অবাধ্য ছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের ভূমিকম্পের আজাব দিয়ে ধ্বংস করেছেন। তাছাড়া ভূমিকম্প কেয়ামতের অন্যতম আলামত। কেয়ামত যতই নিকটবর্তী হবে, ভূমিকম্পের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে, খুনখারাবি বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে তা উপচে পড়বে।’ (বুখারি: ১০৩৬)

আরেক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে হাওয়ালা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমার মাথা বা মাথার তালুতে হাত রেখে বলেন, হে ইবনে হাওয়ালা, যখন তুমি দেখবে যে বাইতুল মাকদিসে (সিরিয়ার) ভূমিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মনে করবে অধিক ভূমিকম্প, বিপদ-আপদ, মহা দুর্ঘটনা ও পেরেশানি সন্নিকটে। কেয়ামত তখন মানুষের এতই নিকটবর্তী হবে, যেমন আমার এ হাত তোমার মাথার যত কাছে আছে। (আবু দাউদ: ২৫৩৫)

অবশ্য মাঝেমধ্যে বান্দাকে সতর্ক করার জন্যও আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্প দিয়ে থাকেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জনপদের মানুষগুলো কি নির্ভয় হয়ে ধরে নিয়েছে যে আমার আজাব তাদের ওপর মধ্য দিনে এসে পড়বে না? তখন তারা খেল-তামাশায় মত্ত থাকবে। কিংবা তারা কি আল্লাহর কলাকৌশল থেকে নির্ভয় হয়ে গেছে? অথচ আল্লাহর কলাকৌশল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত জাতি ছাড়া অন্য কেউই নিশ্চিত হতে পারে না।’ (সুরা আরাফ: ৯৮-৯৯) 

ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য কিছু করণীয় রয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর আমল করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা অদূর ভবিষ্যতে ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা হাদিসে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞরাও নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে একই কথাই বলছেন। বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশও আশংকার বাইরে নয় বলছেন অনেকে। তাই গুনাহের কাজ ত্যাগ করে এখনই সতর্ক হওয়া ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলছেন, ‘যখন আমার আজাব তাদের ওপর পৌঁছল তখন কেন তারা বিনীত হলো না? বরং তাদের হৃদয়গুলো কঠিন হয়ে গেল। তারা যা (অবাধ্যতা) করে যাচ্ছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দেখিয়েছিল। (সুরা আনআম: ৪৩)

ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো—

দান-সদকা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র ও মিসকিনদের দান করতে উৎসাহ দেয় ইসলাম। কেননা রাসুল (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বুখারি: ১৭৩২) ইতিহাসে আছে, ভূমিকম্প হলে উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার গভর্নরদের দান-সদকা করার প্রতি জোর দিতে চিঠি লিখতেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি: ৬০০)

ইস্তেগফার ও তাওবা: যেকোনো বিপদ-মসিবতে ইস্তেগফার ও তওবা করা মুত্তাকিদের একটি বিশেষ আমল। সেজন্য ভূমিকম্পের সময় প্রত্যেক মুসলমানের আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে তাওবা করা উচিত। এক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহর জিকির করো, তাঁর কাছে তওবা করো।’ (বুখারি: ২/৩০; মুসলিম: ২/৬২৮)

সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ: ভূমিকম্পসহ যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নেতৃস্থানীয়দের করণীয় হলো— অধীনদের সত্য ও সঠিক পথে চলতে আদেশ দেওয়া, নিজ নেতৃত্বাধীন এলাকায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা এবং লোকদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি—তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি: ৪/৪০৬, নম্বর: ২১৬৯, ভা-২/৪০) 

নামাজ ও সবর: সাহাবিদের জীবনেতে আমরা দেখি, বিপদে-মসিবতে তাঁরা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মেশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৪৫) 

তাকওয়া: আল্লাহর গজব ও যেকোনো মসিবত থেকে বেঁচে থাকার বড় উপায় হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনত এবং (আল্লাহকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সুরা আরাফ: ৯৬)

দোয়া: ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ, বিপদ-মসিবতে দোয়া পাঠের শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। যে কোনো দোয়া করা যায়, তবে বিপদ-মসিবতে বিশেষভাবে যে দোয়াটি পড়ার কথা পাওয়া যায় তা হলো—  لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত।’ (আহমদ, তিরমিজি, মেশকাত: ২২৯২)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে গুনাহমুক্ত জীবন-যাপন করার, বেশি বেশি দান-সদকা, দোয়া ও তওবা করার তাওফিক দান করুন। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।