কর্নাটকে বিধানসভা ভোটে বিজেপির হার, নাটকীয় জয়ের পথে কংগ্রেস

কর্নাটকে বিধানসভা ভোটে বিজেপির হার, নাটকীয় জয়ের পথে কংগ্রেস

কর্নাটকে বিধানসভা ভোটে বিজেপির হার, নাটকীয় জয়ের পথে কংগ্রেস

কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে ভারতীয় সময় বিকেল তিনটে পর্যন্ত কংগ্রেস জিতেছে ৪৮টি আসনে এবং তারা এগিয়ে রয়েছে ৮৯ টি আসনে। বিজেপি জয়ী হয়েছে ২০টিতে, এগিয়ে ৪২টিতে আর জনতা দল (সেকুলার) এগিয়ে আছে ১৫টি আসনে । গণনা এখনও চলছে।

কর্নাটকের ২২৪ আসনের বিধানসভায় ‘ম্যাজিক ফিগার’ হচ্ছে ১১৩টি আসন, যা কংগ্রেস ছুঁয়ে ফেলে ভোট গণনা শুরু হওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই।বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই ইতোমধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির নেতা-কর্মীরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমরা দাগ কাটতে পারি নি, কংগ্রেস পেরেছে।"" বিশদ ফলাফল এলে আমরা পর্যালোচনা করব। এই ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যাতে লোকসভা নির্বাচনে ফিরে আসতে পারি, সেই চেষ্টা করব“ - বলেন তিনি।

মি. বোম্মাই শিগ্গাও কেন্দ্রে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, কংগ্রেসের ইয়াসির আহমেদ খান পাঠানের থেকে ২৬ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে আছেন।অন্যদিকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডিকে শিবকুমার কনকপুরা আসনে ১২ রাউন্ড গণনার শেষে ৭০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছেন, আর বিজেপির প্রার্থী, প্রাক্তন উপ মুখ্যমন্ত্রী আর অশোকা পেয়েছেন প্রায় ১১ হাজার ভোট।সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন শনিবার।

তার কথায়, “সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আর দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে রাজ্যটা তাদের উৎসর্গ করব। এই জয়ের জন্য কৃতিত্ব দলের কর্মী আর নেতাদেরই প্রাপ্য।“তাকে যখন কেন্দ্রীয় এজেন্সি অর্থ পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার করে ৫০ দিন জেলে রেখেছিল, সেই সময়ে কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সনিয়া গান্ধী, সেই ঘটনাও আজ সাংবাদিকদের সামনে উল্লেখ করেন মি. শিবকুমার।

নজরে যেসব ভিআইপি আসনে

যেসব আসনগুলিতে কংগ্রেস, বিজেপি এবং রাজ্যভিত্তিক দল জনতা দল (সেকুলার)-এর বড় নেতারা প্রার্থী হয়েছিলেন, তার মধ্যে আরও রয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা মি. সিদ্দারামাইয়ার ভরুণা আসন, জনতা দল (সেকুলার) এর প্রধান ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়ার পুত্র এইচডি কুমারস্বামীর ছন্নাপাটনা আসন এবং নির্বাচনের ঠিক আগে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া নেতা জগদীশ শেট্টারের হুবলী-ধারওয়াড় কেন্দ্রগুলি।

ভরুণা আসনে কংগ্রেস নেতা মি. সিদ্দারামাইয়া দশম রাউন্ডের গণনা শেষে বিজেপি প্রার্থীর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন।হুবলী-ধারওয়াড় সেন্ট্রাল আসনে জগদীশ শেট্টার বিজেপি প্রার্থীর থেকে ৩৫ হাজার ভোটে পিছিয়ে আছেন।ছন্নাপাটনা কেন্দ্রে এইচডি কুমারস্বামীর সঙ্গে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির সিপি যোগেশ্বরের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ভারতীয় সময় বেলা দেড়টা পর্যন্ত।

একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে চলেছে কংগ্রেস

গত ১০ই মে ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হওয়ার পরে একাধিক 'বুথফেরত সমীক্ষায়' পূর্বাভাস মিলেছিল যে ক্ষমতায় আসতে চলেছে কংগ্রেস।

কয়েকটি সমীক্ষা বলেছিল ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হবে, যে ক্ষেত্রে সরকার গড়তে জনতা দল (সেকুলার)-এর সহায়তা নিতে হতে পারে কংগ্রেস বা বিজেপিকে। একটি মাত্র সমীক্ষা বিজেপি সরকার গড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল।তবে এখনও পর্যন্ত যা ফলাফল দেখা যাচ্ছে, তাতে কংগ্রেস একার জোরেই সরকার গড়তে পারবে, জনতা দল (সেকুলার)-এর সহায়তার কোনও প্রয়োজনই হবে না বলে মনে করছেন বেঙ্গালুরুতে বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতা ইমরান কুরেশি।

উৎসব শুরু কংগ্রেস দপ্তরে

জয়ের দিকে এগোতেই বেঙ্গালুরুতে প্রদেশ কংগ্রেস দপ্তর আর দিল্লির সদর দপ্তরে শুরু হয়ে গেছে উৎসব। চলছে বাজি পটকা ফাটানো, মিষ্টি বিতরণ। দলীয় কর্মীরা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে মিষ্টি বিতরণ করছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডিকে শিবকুমারের বাড়ির সামনেও।দিল্লির সদর দপ্তরের সামনে সনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধীর ছবি নিয়ে উৎসব যেমন হচ্ছে, তেমনই ‘কর্ণাটক বিজয়’ লেখা একটা হোর্ডিংও লাগানো হয়েছে।

তবে কংগ্রেস আশঙ্কা করছে যে বিধায়ক কেনাবেচায় নামতে পারে বিজেপি। এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস নেতা কমল নাথ।তিনি বলেছেন, “অন্যান্য দলের বিধায়ক বা নির্দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে একটা চুক্তি করার চেষ্টা করতে পারে বিজেপি, তাদের কেনার চেষ্টা করতে পারে। তারা এটাই সবসময়ে করে থাকে।“দলীয় বিধায়কদের যাতে কেউ অর্থের টোপ না দিতে পারে, সেজন্য গণনা শুরুর আগেই কংগ্রেস বিধায়কদের এক জায়গায় রাখার জন্য বেঙ্গালুরুর কাছে একটা সাত তারা রিসর্ট বুক করে রেখেছে।

'অপারেশন কমল'

কংগ্রেসের এই আশঙ্কার ভিত্তি বছর চারেক আগের ‘অপারেশন কমল’ নামে পরিচিত কংগ্রেস ও জনতা দল (সেকুলার)-এর সরকার ফেলে দিয়ে নিজেদের সরকার গঠনের এক সফল কর্মকাণ্ড।

২০১৮ সালের ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েছিল বিজেপিই। তাদের আসন ছিল ১০৪টি, কংগ্রেস পেয়েছিল ৮০টি আর জনতা দল (সেকুলার) পেয়েছিল ৩৭ টি আসন।প্রথমে বিজেপি সরকার গড়েছিল, কিন্তু আস্থা ভোটে তারা হেরে যায়, যৌথভাবে সরকার গড়ে কংগ্রেস এবং জনতা দল (সেকুলার)। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জনতা দলের এইচডি দেবেগৌড়া।

১৪ মাস পরে ক্ষমতাসীন দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন ১৭ জন বিধায়ক, যার ফলে বিজেপি আবারও সরকার গড়তে সক্ষম হয়।কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলি বলে থাকে ওই ১৭জনকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে দল ভাঙ্গিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিজেপি।ওই ঘটনাকেই ‘অপারেশন কমল’ বলা হয়ে থাকে।

হাই ভোল্টেজ প্রচার

আগামী বছরই ভারতে হবে লোকসভা নির্বাচন, তার আগে বিজেপি এবং কংগ্রেস – দুই দলের কাছেই কর্নাটক ছিল ‘প্রেস্টিজ ফাইট’।এই ভোটের ফলাফল থেকে দুই দলই ভোটারদের মন বোঝার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল, তাই নির্বাচনী প্রচারে পূর্ণ শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছিল কংগ্রেস আর বিজেপি।

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গের নিজের রাজ্য কর্নাটক।বিজেপি প্রচার পর্বের গোড়ার দিকে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো নিয়েই প্রচার চালাচ্ছিল, কিন্তু শেষের দিকে তারা তাদের পরিচিত এজেন্ডা, ধর্মকে সামনে নিয়ে আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল কংগ্রেসই। তারা তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে লিখেছিল যে ক্ষমতায় এলে কংগ্রেসের সরকার রাজ্যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বজরং দল এবং কট্টর ইসলামি সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া – দুটিকেই নিষিদ্ধ করবে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি আসরে নেমে পড়ে এই বলে যে কংগ্রেস ‘বজরংবলী’, অর্থাৎ হিন্দুদের কাছে আরাধ্য ভগবান হনুমানের জয়ধ্বনি দেয় যে বজরং দল, তাদের নিষিদ্ধ করার কথা বলছে।

অন্যদিকে প্রথম থেকেই কংগ্রেসের প্রচারের মূল অস্ত্র ছিল বিজেপি সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতির প্রশ্নটি।বিজেপির হয়ে প্রচারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই। অন্যদিকে বহুদিন বাদে ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন সনিয়া গান্ধীও। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও বারেবারে কর্নাটকে প্রচার চালিয়েছেন।ভোটের অনেক আগে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রাও কর্নাটকের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছিল।

সূত্র : বিবিসি