কাজী সালাউদ্দিনের আমলে বাফুফের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

কাজী সালাউদ্দিনের আমলে বাফুফের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

কাজী সালাউদ্দিনের আমলে বাফুফের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

এক মাস ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে চলছে টালমাটাল অবস্থা- সাধারণ সম্পাদকের ওপর ফিফার নিষেধাজ্ঞা এবং সবশেষ গত সপ্তাহে যোগ হয়েছে বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনসহ শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট।

ফিফা যদিও আর্থিক অনিয়মের জন্য বাফুফে সভাপতিকে দায়ী করেনি, তবে পুরো বিষয়টি যে তার জন্য ব্যাপক বিব্রতকর তা নিয়ে সন্দেহ নেই।গত ১৫ বছরে বাফুফের শীর্ষ পদ ধরে রাখা সাবেক ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন নানা কারণে বারবার সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন।২০১৩ সালে কাজী সালাউদ্দিন নেদারল্যান্ডসের লোডভিক ডি ক্রুইফকে কোচের দায়িত্ব দেয়ার সময় যখন বলেছিলেন বাংলাদেশ ২০২২ বিশ্বকাপে খেলবে, এটাকে তখনই অনেকেই ‘অবাস্তব’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

এরপর ১০ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যে শুধু যেতে পারেনি তাই নয়, র্যাংকিংয়ে ১৬৪ থেকে ২৮ ধাপ নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯২ তম অবস্থানে।যদিও ২০২০ সালে নির্বাচনের সময় কাজী সালাউদ্দিন বলেন তিনি এই কথা বলেননি এবং তিনি উল্লেখ করেন, ‘উত্তীর্ণ হতে চেষ্টা করবেন’ বলেছেন।বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২২ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইপর্বও পেরুতে পারেনি বাংলাদেশ দল ।

বাংলাদেশের ফুটবলের এই ক্রমাবনতির পেছনে অনেকেই দায়ী করেন পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিকতার অভাবকে। ২০০৮ সাল থেকে ১৫ বছরে জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বই পালন করেছেন ১৫ জন। কোচের বেতন-ভাতা নিয়ে বেশ কয়েকবার ফিফার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে বাফুফে।

সাধারণ সম্পাদকের নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদ্য সাবেক হওয়া সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের ওপর আসা ফিফার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চলছে তদন্ত, টানা তিনটি বৈঠক করেছে আট সদস্যের কমিটি, কমিটির প্রধান কাজী নাবিল আহমেদ বলেন এখনও পর্যন্ত বাফুফের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।তবে এই কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলারদের অনেকে।

গত মাসে ফিফা বাফুফের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার পর গত সপ্তাহে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন সোহাগ, তিনি বলেন আপিল করে নিজের ওপর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন এবং ‘কোর্ট অফ আর্বিট্রেশনে’ আবেদন করেছেন।

যদিও ফিফার নিষেধাজ্ঞা আবু নাঈম সোহাগের ওপর এবং বাফুফের অন্য কর্তাব্যক্তিদের ওপর কোনও অভিযোগ নেই ফিফার বিবৃতিতে, কিন্তু বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলাররা মনে করেন এখনই সময় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষ থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় খতিয়ে নতুন করে সব ঢেলে সাজানোর।বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে প্রায়ই এমন সব ঘটনা নিয়ে সবার নজর থাকে যার সাথে ফুটবলের সরাসরি সম্পর্ক থাকে না।

জাহিদ হাসান এমিলি বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার। তিনি বলেন এখন তো কথা হওয়া উচিৎ সাফ ফুটবলের প্রস্তুতি নিয়ে, এটা নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা নেই। মাঠের ফুটবলে ভালো না করলে এসব ঘটনার মধ্যেই থাকবে বাংলাদেশের ফুটবল।

“এটা ধরে নেয়াই যায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে সাফ ফুটবল নিয়ে কোনও চিন্তা নেই, ফুটবলের অনিয়মের প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়া শুরু করেছে এবং অনেক দিনের অনিয়মের কারণে দেশের ফুটবল একটা শঙ্কার মধ্যে পড়েছে”।বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন অনেকটাই নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজ করে এমন একটা অভিযোগ তুলেছেন সাবেক ফুটবলারদের একটা দল।

এক সময়ের তারকা ফুটবলার আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে থাকা এই দলটি বাংলাদেশ সরকারের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে বাফুফের কাঠামোতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছেন।

ভারতের ফুটবলে দেখা যায় রাজ্যগুলোতে যে লিগ আয়োজিত হয় সেখান থেকেই শীর্ষ ফুটবলাররা জাতীয় দলের ক্যাম্পে খেলার সুযোগ পান এবং এতে করে বিভিন্ন পর্যায় থেকেই সেরা ফুটবলারদের অন্তত ৫০ জনের একটি পুল তৈরি করা যায়।কিন্তু বাংলাদেশে জেলা পর্যায়ের ফুটবলকে বাফুফে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়শনের প্রতি বছর লিগ করার বাধ্যবাধকতা থাকে, বাফুফের একটা তহবিলও আছে এই লিগের জন্য, ফিফার মনিটরিং থাকে এই লিগ তদারকির জন্য।

'দুই লাখ টাকায় লিগ সম্ভব?'

২০১৬ সালের নির্বাচনে ঢাকায় বিলাসবহুল হোটেল ভাড়া করে জেলা পর্যায়ের কাউন্সিলরদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন।এরপর ২০১৮ সালে প্রতি লিগের জন্য জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে ১ লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।সেবার বলা হয়েছিল যদি লিগ সম্পন্ন করা হয় তবে ২ লাখ টাকা দেয়া হবে।

বাংলাদেশের একজন ফুটবল সাংবাদিক মাহফুজুল ইসলাম বলেন, “প্রতিবার দেখা যায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে জেলার একটা আধিপত্য থাকে, বিশেষত নির্বাচনের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল জেলাভিত্তিক লিগের জন্য”।

কিন্তু নির্বাচন শেষ হলে ফুটবল ফেডারেশন যেভাবে জেলার সাথে সমন্বয় করার কথা সেটা হয় না বলছেন এই ফুটবল সাংবাদিক।এ বিষয়ে নীলফামারি জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরিফ হোসেন মুনের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলা ফুটবল তদারকির বিষয়টি পুরোপুরি কাজী সালাউদ্দিন দেখার কথা, তিনিই জেলা ফুটবল কমিটির প্রধান, কিন্তু দুই বছরেও কোনও বৈঠকে বসেননি তিনি।

আরিফ হোসেন মুন বলেন, “জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলো নির্বাচন কেন্দ্রিক ডাকাডাকি করে, ফাইভ স্টার হোটেলে রাখে, ওই পর্যন্তই এর পর আর খোঁজ থাকে না”।তিনি প্রশ্ন তোলেন, “ভেবে দেখেন যদি লিগ বাধ্যতামূলক হয়, সব অ্যাসোসিয়েশনই লিগ করতে বাধ্য। কেন করবে না? কিন্তু দুই লাখ টাকায় একটা জেলা লিগ হয়? সম্ভব?”

ক্লাবে বিনিয়োগ নেই

জেলায় ফুটবল লিগ আয়োজন এবং সেটার প্রচার প্রসারের জন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষক। সেখানেও বিনিয়োগ দেখা যায় না।সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসার পর বাংলাদেশের ফুটবলে একটা পরিবর্তনের আভাস বলেছিলেন বিশ্লেষকরা, কিন্তু সাইফ স্পোর্টিং এখন অতীত ইতিহাস।

পেশাদার লিগ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব, এই ক্লাবে বাংলাদেশের জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূইয়াও খেলেছেন এবং অধিনায়কত্ব করেছেন।গত বছর বাফুফের কাছে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে ফুটবলের সকল কার্যক্রম থেকে তারা গুটিয়ে নিয়েছে।সাইফ পাওয়ারটেক এই ক্লাবটির অর্থায়নে এই ক্লাবটি পরিচালিত হতো, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন।

একরকম নি:শব্দেই বিদায় নিয়েছিল দেশের ফুটবলে সাড়া জাগানো এই ক্লাবটি।বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন প্রায়ই অর্থের অভাবের কথা বলে থাকেন, কিন্তু এতো বড় বাজেট নিয়ে আসা একটি ফুটবল ক্লাবের বিদায়ের পর বাফুফে থেকে তেমন উল্লেখ করার মতো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

সর্বশেষ বাফুফে নির্বাচনে কাজী সালাউদ্দিনের বিপক্ষে সভাপতি পদেই দাঁড়িয়েছিলেন তরফদার রুহুল আমিন, কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তিনি সরে দাঁড়িয়েছিলেন।সাবেক ফুটবলারদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “বাংলাদেশের ফুটবলে যারাই আসেন তাদের প্রথম লক্ষ্য সরকার বা ওপর মহলের ঘনিষ্ঠ হওয়া, ফুটবলকে তারা ব্যবহার করেন”।

তবে কাজী সালাউদ্দিন যতদিন ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষে আছেন এই ক বছরে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে বেশ সচেতনভাবেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।কিন্তু আদতে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা মেলেনি কখনোই, জেলা ফুটবল তাও বেশ কিছু জেলায় হয় কিন্তু জাতীয় দল নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সবচেয়ে আলোচিত নির্বাচন ছিল ২০১৬ সালের নির্বাচন, যেবার কাজী সালাউদ্দিনের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন তাবিথ আউয়াল, তিনি সেবার বলেছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগের কথা, নারী ফুটবল লিগ নিয়মিত করার কথা, আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামের কথা।এর একটাও বাস্তবে রূপ নেয়নি বরং ২০২০ সালের নির্বাচনের ইশতেহার দেয়ার সময় বাফুফে সভাপতি বলেন, ২০১৬ সালের ইশতেহার দেয়ার সময় তিনি মিটিংয়ে ছিলেন না।

কাজী সালাউদ্দিনের এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল নারী ফুটবলকে ঘিরে, শেষ পর্যন্ত সাফ ফুটবল জয়ের পর বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আলাদাই আগ্রহ ও উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল।কিন্তু এর ছয় মাস যেতে না যেতেই জানা গেল বেতন পাননা সাফজয়ী নারী ফুটবলাররা, খাবারের মান ও খেলার সরঞ্জাম নিয়েও খুশি নন তারা।এই কথা এমন এক সময় ফাঁস হয় যখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে অর্থের অভাবে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠাতে পারছে না বলে জানায় বাফুফে।

সূত্র : বিবিসি