সাগরে ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরা ঠেকাবে, সমুদ্রে নৌ-নিরাপত্তায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার

সাগরে ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরা ঠেকাবে, সমুদ্রে নৌ-নিরাপত্তায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার

সমুদ্রে নৌ-নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।

২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ। বাংলাদেশে সরকার ইলিশ মাছসহ লোনা পানির অন্যান্য মাছের প্রজনন নিরাপদ করতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের সীমানায় মাছ ধরছে। মিয়ানমার ও ভারতীয় জেলেদের বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমানায় মাছ ধরা পর্যবেক্ষণ, সমুদ্রের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ, সাগরে দুর্ঘটনা রোধ এবং সমুদ্রগামী জাহাজের সাথে চব্বিশ ঘন্টা যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, নজরদারি নিশ্চিতকরণে জিএমসিসি এবং ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম চালু করছে সরকার। সমুদ্রে মেরিটাইম নৌ-নিরাপত্তা ও নজরদারি টেকসই লাইটহাউস এবং টাওয়ার নির্মানের কাজ ৮৬ দশমিক ৭০ শতাংশত বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টাওয়ার নির্মাণ হলে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের নৌ সীমানায় মাছ ধরতে এলে পাকড়াও হবে। সাগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.মোস্তফা কামাল ইনকিলাবকে বলেন, দেশে সমুদ্রনিরাপত্তা কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো না। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, নিঝুমদ্বীপ, চরকুকরি মুকরি, কুয়াকাটা এবং দুবলারচর উপকূলীয় এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস এবং সেফটি সিস্টেম প্রযুক্তি সম্বলিত ৭টি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনে প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সে গুলোর কাজ প্রায় শেষ হচ্ছে। এতে করে সমুদ্রে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। আর বড় ধরনের দুঘর্টনা সহজে ঘটনা রোধ হবে।

বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। বিশাল উপকূলীয় সীমারেখায় প্রাকৃতিক প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, সাগরকন্যা কুয়াকাটা, বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন, অতল গিরিখাদ সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড-এগুলো সবকিছুই নিজ নিজ বৈশিষ্টে অনন্য। দেশের রয়েছে সমুদ্র ও উপকূলীয় পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনা। সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের এত সম্ভাবনা, তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে হলে সমুদ্রনিরাপত্তা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ জাহাজ ভিড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ঘটছে দুর্ঘটনাও। এতে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দর চ্যানেল। এসব দুর্ঘটনা বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি দুর্ঘটনার পর উদ্বেগ জানিয়ে বড় ধরনের অঘটন রোধে বিদেশি জাহাজে পোর্ট স্টেট কন্ট্রোল(সিএসসি) বা ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে বলেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সমুদে সীমনায় নৌ-নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিতকরণে জিএমসিসি এবং ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম প্রকল্পে কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দিযেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ নিদেশনা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, নিঝুমদ্বীপ, চরকুকরি মুকরি, কুয়াকাটা এবং দুবলারচর উপকূলীয় এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস এবং সেফটি সিস্টেম প্রযুক্তি সম্বলিত ৭টি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনে কাজ প্রায় শেষ হচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়। সমগ্র উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রাজধানীর আগারগাঁও নৌপরিহন অধিদপ্তরের নিজস্ব একটি কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের লাইটহাউস প্রকল্পের শূন্য থেকে বাতিঘর ও টাওয়ার নির্মানের কাজ ৮৬ দশমিক ৭০ শতাংশত কাজ বাস্তবায়ন করেছে। আইসিটি কাজ ৩৪ দশমিক৫০ শতাংশ থেকে ৪৫ দশমিক ৮১ শতাংশত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। পুর্ত কাজ ৪০দশমিক ৮১ শতাংশত থেকে ৫৪ দশমিক ৮০ শতাংশত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। বন্ধ হওয়া কাজের পুন:নকশা প্রস্তুত করে গণপুর্ত অধিদপ্তর হতে অনুমোদনের প্রেক্ষিতে এ প্রকল্পের কাজসমূহ দ্রুত চালু করা হয়। বর্তমানে ২৯ শতাংশত থেকে ৯৫ শতাংশত কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। এ মহাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আনসে টেকনোলজি এর সাথে কোরিয়ান সিভিল কনট্রাক্টর সামহি কন্সট্রাকশন।

জানা গেছে, দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগের প্রায় কাছাকাছি আয়তনের জলসীমার আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ নিতে পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যাদি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্যক্ষেত্র। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ-জাতীয় সম্পদ তেল, গ্যাস, চুনাপাথর রয়েছে। এছাড়া ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। সমুদ্রসৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে।

আধুনিক যুগে অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই। এতদিন স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশের এই জ্বালানি সম্পদটির মজুদ কমে গেছে। সেক্ষেত্রে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের অফশোর গ্যাসক্ষেত্রগুলো। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টির আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পাওয়া গেছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ফলে এই ব্লকগুলোয় গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র রূপকল্প- ২০৪১, ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবে রূপদানে সময়োপযোগী ও আধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়নে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, নিঝুমদ্বীপ, চরকুকরি মুকরি, কুয়াকাটা এবং দুবলারচর উপকূলীয় এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস এবং সেফটি সিস্টেম প্রযুক্তি সম্বলিত মোট ৭টি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন করে সমগ্র উপকূলের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রাজধানী ঢাকার নৌপরিহন অধিদপ্তরের নিজস্ব ভবনে কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের নিজস্ব ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজের সাথে চব্বিশ ঘন্টা যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ নৌ-নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি ২০১১ সালে উল্লেখিত সকল সাইটের নির্ধারিত স্থান নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচায়ের কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রকল্পের ব্যয় ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা প্রাক্কলন করে (এর মধ্যে কোরিয়ান ঋণ সহায়তা ৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার যাহা ২৯২ কোটি ১২ লাখ টাকা) ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ডিপিপি একনেকে অনুমোদন করে। প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও শুরু থেকে নানা জটিলতা ও জমি অধিগ্রহণের কারণে দুই দফায় মেয়াদ ও প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক টে-ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঋণ চুক্তি ও উচচ-এর শর্তানুযায়ী কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি সামহি কনসোর্টিয়াম এর সাথে চুক্তি করে সরকার। তবে জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ার কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের শেষের দিকে প্রাথমিক কাজ শুরু করে। এ কাজ চলাকালীন সময়ে ঢালচর সাইটটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং পরে তা নতুন সাইট চর কুকরি মুকরিতে স্থানান্তর করা হয় এবং কোরিয়ান ঋণ সহায়তা পুনরায় না পাওয়ায় উচচ ২য় সংশোধন করে অতিরিক্ত নতুন প্রয়োজনীয় অঙ্গ যুক্ত করে পুনঃ প্রাক্কলিত ব্যয় ৬৮৭ কোটি ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করে অর্থাৎ শুধুমাত্র অংশে ২৩০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বর্ধিত করে প্রকল্পের মেয়াদ পুনরায় গত বছর জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। প্রথম দুইজন প্রকল্প পরিচালকের সময়কালীন নানা অনিয়ম ও প্রতিকুলতার কারণে প্রকল্পের কাজ স্থিমিত হয়ে পরে। প্রকল্পের ৩য় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান গত ২০২১ সালে ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পে যোগদান করেন। করোনার কারণে কাজ কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ইতোমধ্যেই বাতিঘর ও টাওয়ার নির্মানের কাজ ৮৬ দশমিক ৭০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। একই সময়ে আইসিটি কাজ ৩৪ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৪৫দশমিক ৮১ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ভবন নির্মাণের কাজে দায়িত্ব থাকা গণপুর্ত বিভাগ এ প্রকল্পের কাজ ৪০দশমিক ৮১ শতাংশ থেকে ৫৪ দশমিক ৮০ শতাংশ কাজ হয়েছে।

এ বিষয়ে নৌ পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম ইনকিলাবকে বলেন, আমি নতুন এসেছি। তারপর এ প্রকল্প নিয়ে আমি সকলকে দ্রুত কাজ করার নির্দেশনা পিডিকে নিয়েছি।