ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬১% রোগীর বয়স ৩০ এর কম

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬১% রোগীর বয়স ৩০ এর কম

ফাইল ছবি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগ কর্মক্ষম ও  নারী। এ ছাড়া যারা মারা গেছে তাদের ৮০ শতাংশেরই মৃত্যু হয় হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে। দেশে ডেঙ্গু রোগীর ৩৫ শতাংশই শিশু এবং ৬১ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। চলতি বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৯ হাজার ৮৭১ রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। 

আক্রান্তদের ৬২% নারী, ৩৮% পুরুষ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ছয় হাজার ৭১ জন নারী, যা মোট আক্রান্তের ৬২ শতাংশ। আর তিন হাজার ৮০০ জন পুরুষ, যা মোট আক্রান্তের ৩৮ শতাংশ। মোট আক্রান্তের ৮ শতাংশের বেশি, ৮৩৪ জন এক থেকে চার বছর বয়সের; ৮ শতাংশ, ৭৬৬ জন পাঁচ থেকে ৯ বছর বয়সের; ১৯ শতাংশ, এক হাজার ৮৩২ জন ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের। ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সের দুই হাজার ৫৬৯ জন বা ২৬ শতাংশ।

৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সের আক্রান্ত এক হাজার ৫৮৭ জন বা ১৬ শতাংশ। ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের ৯৯৮ জন বা ১০ শতাংশ। ৫০ থেকে ৬০ বছরের ৮৩৪ জন বা ৮ শতাংশ। ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৫১ জন বা ৫ শতাংশ।

মৃতদের বড় অংশই কর্মক্ষম ব্যক্তি

ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তিদের বয়সভিত্তিক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর ৬২.৫ শতাংশ নারী ও ৩৭.৫ শতাংশ পুরুষ। এ ছাড়া বড় অংশই ছিলেন কর্মক্ষম এবং তাঁরা হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা গেছেন।

শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৭.১৪ শতাংশ। ছয় থেকে ১১ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৭.১৪ শতাংশ। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু ১২.৫ শতাংশ।

১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার ৫৩.৫৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৪ জন বা ৭৮.৫৭ শতাংশেরই হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে। ৯ জন বা ১৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে। আর তিনজন বা ৫.৩৫ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে মৃতের হার ১৯.৬৪ শতাংশ। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৫৬ জনের তথ্য পর্যলোচনা করে এই তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

দেরিতে হাসপাতালে আসায় মৃত্যু বাড়ছে

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, এবার সবচেয়ে বেশি রোগী হলো লেট রেফারেল (দেরিতে হাসপাতালে আসছে)। আক্রান্তদের অনেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে। জটিল বা শকে থাকার রোগীরা সংখ্যায় বেশি।

আবার রোগীদের মধ্যে এমন কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। বুঝতে না পারার কারণেও দেরিতে হাসপাতালে আসছে রোগীরা। তারা বাড়িতে থেকে বিভিন্ন ফার্মেসির ওষুধ খেয়েছে, চিকিৎসা নিয়েছে। পরিস্থিতি যখন গুরুতর হচ্ছে তখন হাসপাতালে আসছে। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে এলেও অনেকেই মারা যাচ্ছে।

ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার কমে যাচ্ছে, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। তিন-চার দিনের ডায়রিয়া হচ্ছে—এমন রোগী বেশি আসছে।

জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, যেকোনো ধরনের জ্বর হলে যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকার মেট্রোপলিটন শহরে, বিশেষ করে ডেঙ্গু হয়েছে বলে সন্দেহ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ফামের্সি থেকে বা নিজে ওষুধ কিনে খাবেন না। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ জ্বর মনে করে যদি সময় অতিক্রম করেন, তবে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে। তাই সময় অতিক্রম না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এবং পরীক্ষাটি করাতে হবে। কারণ মূল্যবান সময়টিতে চিকিৎসা নিলে বিপদের আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায়।

৪৪ শতাংশ বহুতল ভবনে এডিস মশার লার্ভা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকাতেই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি বেশি। বহুতল ভবনে এডিসের উপস্থিতি প্রায় ৪৩.৫৩ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে একক বাড়ি ২১.৩১ শতাংশ ও নির্মাণাধীন ভবনে ১৮.২১ শতাংশ। এসব স্থানে পানি জমে থাকা ভেজা মেঝে, প্লাস্টিকের ড্রাম ও পাত্র এবং ফুলের টবে লার্ভা বেশি ছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জটিল। বহুতল ভবনে সিটি করপোরেশনের একজন মশককর্মীর জন্য প্রবেশ করা কঠিন। নাগরিকদের এ বিষয়ে আরো বেশি সমৃক্ত হতে হবে। হটস্পটগুলোতে উড়ন্ত মশা মারতে হবে।

সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডিসবাহী রোগ নির্ণয় কর্মসূচির ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগী আরো অনেক বাড়বে। ডেঙ্গুবাহিত মশার উৎস শনাক্ত ও ধ্বংসের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ প্রতিটি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে জনসচেতনতা তৈরির জন্য।

এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

বুধবার (৫ জুলাই) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অন্ত বিভাগ ও অস্ত্রোপচার কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘প্রতিদিন হাসপাতালে রোগী আসছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু থামাতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এদিকে আপনাদের নজর রাখতে হবে।’

ডিএনসিসির চিরুনি অভিযান

মাসব্যাপী বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আগামী শনিবার (৮ জুলাই) থেকে ডিএনসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডে একযোগে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। বুধবার (৫ জুলাই) সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ড্রোনের মাধ্যমে ভবনের ছাদবাগানে মশার উৎস চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা এই ঘোষণা দেন।

চিকিৎসার মান বাড়ানোর আহ্বান তাপসের

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তাদের চিকিৎসাসেবার মান ও পরিধি আরো বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বুধবার (৫ জুলাই) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলসংলগ্ন হাতিরঝিল পানি নিষ্কাশন যন্ত্র (এসএসডিএস) পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।