ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরিমানা করেই দায় সারছে ২ সিটি করপোরেশন

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরিমানা করেই দায় সারছে ২ সিটি করপোরেশন

ফাইল ছবি

সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বিশেষ করে রাজধানীতে এর প্রভাব খুবই বেশি। প্রতি দিন নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। এদিকে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে কয়েকদিন ধরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে দুই সিটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে। এদিকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি শুধু জরিমানা করেই দায় সারছে।

এডিস মশার প্রজনন মৌসুমে মশার প্রজনন বন্ধে নেই কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা এবং এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। এ কারণে কোনো সুফল মিলছে না। দিন দিন শনাক্তের হার বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার এখনো তেমন কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি।

তাই সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় মশা নিধন কর্মকাণ্ড অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কোথাও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। তাই জরিমানা করে ও লোক দেখানো কিছু কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।

তারা বলছেন, একবার এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংসের পর সেখানে আবার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। লার্ভা শনাক্তে দুই সিটিতে কোনো গবেষণাগারও নেই। নেই কোনো কীটতত্ত্ববিদও। এ কারণে ডেঙ্গু রোধে লোক দেখানো কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুই সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দাবি করছে, সর্বোচ্চ চেষ্টার মধ্যেও প্রতিনিয়তই বাড়ছে আক্রান্ত রোগী এবং মৃতের সংখ্যা।

এ ছাড়া দায়িত্বশীলদের লোক দেখানো অভিযান আর মশক নিধন কার্যক্রম পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ায় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন কম থাকে তখনই কাজ শুরু করা উচিত। মৌসুমের আগে যেসব জায়গায় মশার উপদ্রব বেশি থাকে সেখানে মশা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার।

যেন মৌসুমের শুরুতে এডিস মশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ কারো নেই।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জরিমানার সিস্টেম বিভিন্ন দেশে থাকলেও আমাদের দেশে এ সিস্টেম চালু করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জরিমানা করে কোনো লাভ হবে না। যেভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার সে অনুযায়ী কাজ করছে না রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন।

তিনি বলেন, ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি যেসব দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে তা অবৈজ্ঞানিক ও ভুল। এ কারণে এসব নির্দেশনা ও কার্যক্রম কোনো কাজে আসছে না।

এ ছাড়া দুই সিটিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দক্ষ জনবল নেই। মনগড়া ও উলটাপালটা পরামর্শ নিয়ে তারা কাজ করছে। এতে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। মশা মারতে তারা ফগিং ব্যবহার করছে-অথচ এতে মশা মরে না।

ডেঙ্গু সংক্রমণ কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না, জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তার একটি প্রধান অংশই হচ্ছে প্রদর্শনবাদিতা।

অর্থাৎ তারা যতটা দেখায় ততটা কার্যকরি কাজ তারা করে না।

দ্বিতীয়ত হলো- সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করলেও তাদের পক্ষে একা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একসঙ্গে সাধারণ মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ইউএনবিকে বলেন, মশা নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের কীটতত্ত্ব কারিগরী দক্ষতা নেই। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনে পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ ও সহকারী কীটতত্ত্ববিদ প্রয়োজন। উত্তর সিটিতে একজন কীটতত্ত্ববিদকে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটিতে একজনও কীটতত্ত্ববিদ নেই। পাশাপাশি এ বিষয়ে গবেষণার জন্য ল্যাবরেটরি দরকার। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় দরকার।

এভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ দূর করা যাবে না। বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শ মেনে এবং তাদের নেতৃত্বেই ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, এখনো তেমন কোনো নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। তাই সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় মশা নিধন কর্মকাণ্ড অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

কোথাও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। তাই জরিমানা করে ও লোক দেখানো কিছু কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।

তারা বলছেন, একবার এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংসের পর সেখানে আবার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। তারা তো প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকরী কোনো ভূমিকা নেই। ডেঙ্গু যখন বৃদ্ধি শুধু অভিযান করলে হবে না।

ডেঙ্গু প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকরী ব্যবস্হা নিতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ইউএনবিকে বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

আর এই প্রক্রিয়াতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে।

আগামী দুই মাস হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রমও চালাতে হবে।

ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে জানা যায়, মশা নিধনে ওষুধ ছিটানোর ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

কোনো কোনো জায়গায় মশকনিধনকর্মীর দেখাই মেলেনি, আবার কোথাও টাকা দিলে ঘরের ভেতরে গিয়েও ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। আবার কোথাও কোথাও ওষুধ ছিটালেও মশা যায় না।

মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন খরচ করেছে ১২৮ কোটি টাকা।

এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তুলনায় উত্তর সিটি করপোরেশনের ব্যয় প্রায় চার গুণ বেশি। কিন্তু ফলাফল অনেকটাই শূন্য।

তাদের ব্যর্থতায় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার বিস্তার এখন দেশজুড়ে। ডেঙ্গু এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একইসাথে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও প্রাণহানির সংখ্যা।

মশক নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৭৫টি ওয়ার্ডে কাজ করছে। মশক নিয়ন্ত্রণে ১০৯ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি দুই লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি দুই লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটারের উত্তর সিটিতে মশক নিয়ন্ত্রণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৭০ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০১ কোটি টাকা। সূত্র : ইউএনবি