ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডব্লিউএইচওর সহায়তা চায় বাংলাদেশ

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডব্লিউএইচওর সহায়তা চায় বাংলাদেশ

ফাইল ছবি

দেশে ডেঙ্গু পরিস্তিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। শঙ্কা দেখা দিয়েছে মহামারির। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ এবং এডিস মশার বিস্তার রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার (১ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এক জরুরি বৈঠকে এ সহযোগিতা চাওয়া হয়।

বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণের শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে যাওয়ার আগেই তা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে, ডেঙ্গুর টিকার বিষয়ে ডব্লিউএইচওর কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। টেকনিক্যাল ও লজিস্টিকস সাপোর্ট, র‌্যাপিড টেস্টের কিট সরবরাহসহ বেশ কিছু বিষয়ে এক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। ডব্লিউএইচওর আবাসিক প্রতিনিধি ড. বর্ধন জং রানা সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

রোগ নিয়ন্ত্রণের শাখার এই পরিচালক বলেন, বিশ্বের শতাধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। ডব্লিউএইচও বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করছে। তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। বৈঠকে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবেশী দেশের অভিজ্ঞতা ভাগ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এর আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এবং এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে ডব্লিউএইচও কাজ করার আগ্রহের কথা জানায়। মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর হোসেন বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, যেখানে সেখানে ভবন নির্মাণের কারণে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, ইমাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুতে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে ঢাকার বাইরে। চট্টগ্রাম ও বরিশালে আক্রান্তের হার বেশী। বরিশালসহ আরও কয়েকটি জেলায় সরেজমিন গিয়ে এডিসের ঘনত্ব দেখা গেছে। প্রতিটি জেলা ঝুঁকিপূর্ণের কাতারে আছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, সামনে আরও খারাপ হবে। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে বৈঠকে ডব্লিউএইচওর আবাসিক প্রতিনিধি ড. বর্ধন জং রানাসহ চার সদস্যের প্রতিনিধি, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আহমেদুল কবীর উপস্থিত ছিলেন।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ডব্লিউএইচওর অর্থ সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র কী, তা জানতে মাঠপর্যায়ে গবেষণা চলছে। গাজীপুরে গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা, কিশোরগঞ্জসহ ঢাকার নিকটবর্তী জেলায় শিগগিরই গবেষণা শুরু হবে। চলমান গবেষণায় শুধু সংক্রমণ নয়, যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের অন্যান্য কী কী জটিলতা ছিল, বিশেষ করে কোমর্বিডিটি ছিল কিনা, এমন তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এদিকে ঢাকায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে দেশটির প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছেন। মঙ্গলবার (১ আগস্ট) তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

অপরদিকে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার আলোকে ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে গাইডলাইনে কিছু সংশোধন আনতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বুধবার (২ আগস্ট) এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে ২৭ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৫৮৪ জন। মঙ্গলবার (১ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ঢাকা সিটির ১ হাজার ১৩১ জন এবং ঢাকা সিটির বাইরে ১ হাজার ৪৫৩ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ হাজার ২৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৪ হাজার ৪১৬ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৪৪ হাজার ৮৯১ জন। মারা গেছেন ২৬১ জন। এর মধ্যে ঢাকা সিটির ২০৫ জন এবং ঢাকা সিটির বাইরের ৫৬ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন আর বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। ফলে এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এটি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে সচেতন হতে হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানান, ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ জুন মাস থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর মে মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনে পক্ষ থেকে সব জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে হয়তো রক্ষা পাব, না হলে ডেঙ্গু এবার মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, শক সিন্ড্রোমের কারণে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। তাই অবহেলা না করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছরব্যাপী নানা উদ্যোগ নিলেও কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলছেন, মশা নিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেনতনা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এরমধ্যে মারা গেছেন ২৮১ জন।