মোদীর বিরুদ্ধে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়বে 'ইন্ডিয়া'?

মোদীর বিরুদ্ধে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়বে 'ইন্ডিয়া'?

মোদীর বিরুদ্ধে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়বে 'ইন্ডিয়া'?

ভারতে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে মঞ্চ গড়েছে বিরোধীরা৷ ঘোষিত লক্ষ্য একটাই, হারাতে হবে ৷ যদিও 'ইন্ডিয়া' জোটের একাধিক দলের মধ্যে বনিবনা নেই৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারবে 'ইন্ডিয়া'?

নয়া জোটের জন্ম

প্রায় এক দশক ধরে ভারতের রাজনীতি মোদীময়৷ শুধু লোকসভা নয়, বিধানসভা ভোটেও বিজেপি জয় পেয়েছে তার মুখ সামনে রেখে৷ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন জোরালো ভাবে উঠছে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের মুখে৷ এর সঙ্গে রয়েছে নয় বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা৷ 

এই পরিস্থিতিতে একজোট দেশের কয়েকটি অগ্রণী বিরোধী শক্তি৷ কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে ১৭ ও ১৮ জুলাই বিরোধীদের সম্মিলিত সভায় জন্ম হয়েছে নয়া জোটের৷ বিরোধীদের দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছে বিহারের পাটনায়৷ জোটের নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলেপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (আইএনডিআইএ) বা 'ইন্ডিয়া'৷ 

জোটে রয়েছে ২৬টি দল৷ কংগ্রেস ও বামপন্থীদের পাশাপাশি শরিক পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, বিহারের জনতা দল ইউনাইটেড, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, দিল্লির আম আদমি পার্টি, মহারাষ্ট্রের এনসিপি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ একঝাঁক আঞ্চলিক দল৷

শুধু বৈঠক নয়, ময়দানের লড়াইয়ে জোটের নেতাদের একসঙ্গে সামিল হতে দেখা যাচ্ছে৷ মণিপুর ইস্যুতে সংসদের ভিতরে ও বাইরে প্রতিবাদে একজোট বিরোধীরা৷  প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করে লোকসভার চলতি বাদল অধিবেশনে অচল করে রেখেছে 'ইন্ডিয়া'৷ জোটের প্রতিনিধিরা গিয়েছেন মণিপুর সফরে৷ একসঙ্গে দরবার করেছেন রাষ্ট্রপতির কাছে৷

বিজেপি উদ্বেগে?

কিছুদিন আগেই নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, তিনি একাই সব বিরোধীর থেকে বেশি শক্তিশালী! ছবিটায় এখন বদল দেখা যাচ্ছে৷ পাটনায় যেদিন বৈঠকে বসেছিল বিরোধী জোট, সেই দিনই দিল্লিতে 'মৃতপ্রায়' এনডিএ-র সভা ডাকে বিজেপি৷ ৩৮টি দল তাতে যোগ দেয়৷

২৫ বছর আগে এনডিএ তৈরি হয়েছিল৷ বছরের পর বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই জোট ছিল কার্যত অস্তিত্বহীন, তাকে ফের কেন জাগিয়ে তোলা? যেখানে ৩৮টি দলের মধ্যে ১৬টির লোকসভায় কোনো প্রতিনিধি নেই৷ কখনো ভোটে লড়েনি নয়টি দল৷প্রধানমন্ত্রী 'ইন্ডিয়া' জোটের নাম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মতো সংগঠনের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন৷ তা হলে কি বিজেপি বিরোধীদের সঙ্ঘবদ্ধ চেহারা দেখে উদ্বেগে?

বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ভারতের মানুষ জনতা সরকার দেখেছে৷ ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, গুজরাল, দেবগৌড়ার সরকার দেখেছে৷ ভোটাররা অস্থায়ী সরকার চান না৷ তাই বিরোধীদের এই জমায়েত নিয়ে বিজেপি চিন্তিত নয়৷"শমীকের সওয়াল, "যে বাম ও কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা পশ্চিমবঙ্গে খুন হচ্ছেন, যারা বলছেন মোদী-দিদি গটআপ, তারা কীভাবে ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে হাত মেলাচ্ছেন?"

'ইন্ডিয়া' অন্দরে

বিজেপির এই প্রশ্ন অস্বস্তিতে রাখছে জোটকে৷ 'ইন্ডিয়া'র শরিকরা একাধিক রাজ্যে যুযুধান৷ একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেয়ার ফর্মুলা বার করা কি সহজ হবে? সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেই দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না৷ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ বিষয়ে নীরব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ নেতৃত্ব তৃণমূলের বিরুদ্ধে একেবারে খড়্গহস্ত৷

তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, গণতন্ত্র হত্যার ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে৷ গত মাসের পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্যের শাসক-বিরোধী সংঘাতকে আরো তীব্র করেছে৷ দুই পক্ষের হানাহানিতে ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে৷

কংগ্রেস নেতা, আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "২০১১ সাল থেকে তৃণমূল এখানে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার বিরোধিতা করতেই হবে৷ এরা কংগ্রেসকে দিনের পর দিন দুর্বল করেছে৷ এরা পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত৷ তৃণমূলকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়া হবে না৷"

জোটে চাপানউতোর

তৃণমূল জাতীয় ও রাজ্যের পরিস্থিতিকে আলাদা করে দেখছে৷ তৃণমূল মুখপাত্র, আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজ্যে লড়াই হবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় স্তরে সবাই একটি বিষয়ে একমত-বিজেপি সরকারকে সরাতে হবে৷ রাজ্য ও কেন্দ্রের রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না৷ গণতন্ত্র, সংবিধান রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে এটা জরুরি৷"

কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধেই তো গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ উঠছে! বিশ্বজিতের ব্যাখ্যা, "বিরোধীরা পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালিয়েছে৷ আমাদের ১৮ জন কর্মী খুন হয়েছেন৷ ৬০ হাজারের বেশি বুথের কতগুলিতে গন্ডগোল হয়েছে? ভোটের ফলই বলছে মানুষ কাদের পক্ষে৷"

বিজেপি ও তৃণমূল, উভয়কেই প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে বাম-কংগ্রেস৷ একই সুর আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর৷ তার প্রশ্ন, "পশ্চিমবঙ্গে যারা সংবিধান রক্ষা করছে না, তারা কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে কী লড়বে?"

কৌস্তভের মন্তব্য, "বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই হবে৷ এ রাজ্য থেকে তৃণমূলকে উৎখাত করা ততটাই জরুরি৷ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে যে নির্দেশ পেয়েছি, তাতে আমাদের তৃণমূল বিরোধিতা জারি থাকবে৷"

এই সংঘাত কি 'ইন্ডিয়া'র সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিতে পারে? সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে যেমন বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের লড়াই, তেমনই কেরলে বাম ও কংগ্রেস মুখোমুখি৷ দিল্লি ও পঞ্জাবে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির লড়াই৷ এটা কেন্দ্রে সরকার নির্বাচনের ভোট৷ বিজেপি বিরোধিতার লক্ষ্যে সবাই এক থাকলে রাজ্যের পরিস্থিতি বাধা হবে না৷"

ভোটের অঙ্ক

এমন জটিল সমীকরণের মধ্যে ভোটের পাটিগণিত নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে৷ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একই ৩০৩টি আসনে জিতেছিল৷ উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, বিহারের মতো যে রাজ্যগুলিতে বেশি আসন রয়েছে, সেখানে বিজেপি চূড়ান্ত ভালো ফল করেছিল৷ পশ্চিমবঙ্গে অভাবনীয় ভাবে ১৮টি আসনে জেতে তারা৷ এ সব রাজ্যে তাদের আসন সংখ্যা কমার আশঙ্কা রয়েছে৷

দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৬টিতে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে৷ সম্প্রতি কর্নাটকে ভোটে কংগ্রেসের বিপুল জয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছে গেরুয়া শিবির৷ এ বছরের শেষে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন৷ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের দিকে নজর রয়েছে৷ এখানে কংগ্রেস জিতলে বিজেপির উপর চাপ আরো বাড়বে৷

এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা জোট বাঁধায় বিজেপির কাজ কি কঠিন হবে? সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "গত লোকসভায় বিজেপি ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ এনডিএ মিলিয়ে ৪৫ শতাংশ৷ সেই সময়ের জোটসঙ্গী জেডিইউ, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা বেরিয়ে গিয়েছে৷ অকালি দলও নেই সঙ্গে৷ ২০১৯-এ কংগ্রেস ১৯ শতাংশের বেশি ভোট পায়৷ 'ইন্ডিয়া' জোটের বাকি শরিকরা ২০ শতাংশের মতো৷ তাই অঙ্কের হিসেবে দুই পক্ষের বিশেষ ফারাক নেই৷"

মোদী বনাম

বিজেপি বারবার প্রশ্ন তোলে, মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের নেতা কে? কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী 'ভারত জোড়ো' যাত্রা করে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন৷ কিন্তু বিরোধী জোটের আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে একাধিক মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন যারা অভিজ্ঞতায় রাহুলকে পেছনে ফেলবেন৷ পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারের নীতীশ কুমার, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা কি কুর্সির দৌড়ে নেই?

বিরোধীরা বলছে, জোটের নেতা পরে ঠিক হবে৷ এখন জোট সক্রিয় থাকবে ইস্যুর ভিত্তিতে৷ আজো মণিপুর নিয়ে বিরোধীদের হইচইয়ে সংসদ অচল হয়ে পড়ে৷ মণিপুর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিরোধীরা৷ হার নিশ্চিত জেনেও একজোট হওয়ার বার্তা দেশকে দিতে চাইছেন রাহুলরা৷এখনো পর্যন্ত কোনো শিবিরেই না থাকা তেলঙ্গনা ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি, ওড়িশার বিজু জনতা দল, অন্ধ্রের তেলুগু দেশম, ওয়াই এস আর কংগ্রেস কোন দিকে যাবে, নজর রয়েছে সেই দিকেও৷ এ বছরের বিধানসভা নির্বাচন সেমিফাইনাল৷ তার ফলাফলের পর দুই শিবির বিভাজন স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা৷

সূত্র : ডয়চে ভেলে