বিজেপি কেন পুরো ভারতে একসাথে ভোট করতে চায়?

বিজেপি কেন পুরো ভারতে একসাথে ভোট করতে চায়?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

ভারতের লোকসভা নির্বাচন আর সবকটি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন একইসাথে করানো অনেকদিন আগে থেকেই বিজেপির লক্ষ্য, তবে এবারই প্রথম সে উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নিলো তারা।

সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন’ নীতি বাস্তবায়ন করা যাবে কী না, তা খতিয়ে দেখবে।

সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এখন তো শুধু কমিটিই তৈরি হয়েছে। তারা গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবে, তা নিয়ে বিচার বিবেচনা, বিতর্ক হবে সংসদে।’

‘ভারতে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তো একসাথেই লোকসভা আর বিধানসভাগুলোর নির্বাচন হত। এটা নিয়ে আলোচনা তো হতেই পারে,’ বলেছেন যোশী।

মোদি চান একসাথে ভোট করাতে
বিগত বেশ কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও লোকসভা আর বিধানসভাগুলোর নির্বাচন একসাথে করার কথা বলছেন। মোদি যে বছর প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারেও বিজেপি লিখেছিল যে তারা সারাদেশে একসাথে ভোট করাতে চায়।

সাবেক রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি তৈরি করে দিয়ে সরকার এটা বোঝাতে চেয়েছে যে এখন বিষয়টা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

শুধু যে প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার বিষয়টা উত্থাপন করেছেন, তা নয়। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কোভিন্দও মোদির ভাবনার সাথে সহমত পোষণ করেছিলেন।

ইতিহাস বলছে, লোকসভার ক্ষেত্রে সাতবার মেয়াদের আগে সরকার পড়ে গেছে বলে ভোট করতে হয়েছে। সব রাজ্য বিধানসভাগুলোর হিসেব মেলালে দেখা যাবে - এক শ’রও বেশি বার রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ফলে মধ্যবর্তী নির্বাচন করতে হয়েছে।

কোন প্রক্রিয়ায় সারাদেশে একবারই ভোট?
বর্তমানে রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভার ভোট পাঁচ বছর অন্তর হয়ে থাকে। যদি কোনো রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে পাঁচ বছরের আগেই ভোট হয়।

আবার সরকার পড়ে গেলে ভোট না করেও নতুন সরকার গঠন করা যায়, যেমনটা করা হয়েছিল গতবছর মহারাষ্ট্রে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার যদি বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে যায়, সেক্ষেত্রে রাজ্যপাল এমন কাউকে সরকার গড়ার জন্য ডাকতে পারেন- যার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমএলএ-র সমর্থন রয়েছে বলে তার মনে হবে ।

এই ক্ষেত্রে রাজ্যপাল, যিনি আবার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি, তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কিন্তু এখন যেসব রাজ্যে সরকার চলছে এবং তার পূর্ণ মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছর পর্যন্ত সরকার চালানোর ক্ষেত্রে কোনো আশু বিপদও নেই, তাদেরও ভোট কি সারাদেশে একসাথে ভোট করানোর প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা হবে?

সেই সব বিধানসভা কি ভেঙে দেয়া হবে? পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলো কি সেই প্রস্তাব মেনে নেবে?

সিনিয়র সাংবাদিক প্রদীপ সিং বলছেন, ‘এ নিয়ে দু’টি প্রস্তাব আগে থেকেই এসেছে। একটা হতে পারে যে লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে আর পরে যেসব রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন নির্ধারিত হয়ে আছে, সেই সবগুলো একসাথে মিলিয়ে লোকসভা ভোটের সঙ্গে করানো হল।

‘দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলো বিজেপি আর সহযোগী দলগুলোর সরকার যেসব রাজ্যে আছে, তারা নিজেরাই বিধানসভা ভেঙে দিলো আর বাকি রাজ্যগুলোতে সরকার বরখাস্ত করে দেয়া হলো,’ বলছিলেন সিং।

নির্বাচন কমিশন আগে একাধিকবার বলেছে যে সারাদেশে একসঙ্গে ভোট করানোর মতো লজিস্টিকাল বন্দোবস্ত তাদের রয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন সেখানেও থেকে যায়, এত বড় দেশে একসাথে ভোট করাতে গেলে সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে এবং অন্যান্য এলাকাতেও যত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে, সেটা কি সম্ভব হবে?

পক্ষে-বিপক্ষে যেসব যুক্তি
সারাদেশে একইসাথে লোকসভা আর রাজ্য বিধানসভাগুলোর ভোট করানো নিয়ে বিরোধী দলগুলির সাথে বিজেপির মতপার্থক্য আছেই।

বিজেপির যুক্তি, একোথে সারাদেশে ভোট করালে নির্বাচনের বিপুল খরচ অনেকটা বাঁচবে। সেই অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে দলগুলো নির্বাচনী প্রচার করতে পারবে, তাতে কমে যাবে রাজনৈতিক দুর্নীতি।

এছাড়াও একেক রাজ্যে একেক সময়ে ভোট হওয়ার ফলে আদর্শ আচরণ বিধি বলবৎ হয়ে যায়, যার ফলে সরকারি প্রকল্প রূপায়ন বন্ধ থাকে,এই যুক্তিও দিচ্ছেন দলের নেতারা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিজেপি নেতা বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, ‘আমাদের মতো দেশে যেখানে সম্পদ খুব বেশি নেই, সেখানে সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করতে হবে। দেশের একটা বিরাট খরচ হয়ে যায় এই নির্বাচনগুলো করতে গিয়ে। তারওপরে যদি উপনির্বাচন হয় বা মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়, বিধানসভা বা লোকসভা উভয়েরই ক্ষেত্রে, তাতে বিপুল একটা খরচ হয়।

‘এরপরে ভোট এলেই আদর্শ আচরণ বিধি চালু হয়ে যায়, উন্নয়নের কাজ আটকিয়ে যায়। সব মিলিয়ে ভারতের মতো একটা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট হয়। এটা ভারতবর্ষের সামর্থ্যের বাইরে’ বলছিলেন বিমল শঙ্কর নন্দ।

এই যুক্তির পাল্টা প্রশ্ন করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।

তার কথায়, ‘ধরে নেয়া যাক ২৮টা রাজ্য বিধানসভা আর লোকসভার নির্বাচন একসাথে করানো হলো। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে সেই সরকারগুলো চলবে যতদিন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে, ততদিন। কিন্তু তার আগে যদি কোনো সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, সেক্ষেত্রে কী হবে? পাঁচ বছরের বাকি সময়টায় কি সেখানে কোনো নির্বাচিত সরকার থাকবে না?’

তিনি বলছেন, ‘এক রাষ্ট্র এক নির্বাচন নীতি ভারতের সংসদীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সম্ভব না। এটা অবাস্তব।’

কিন্তু বিজেপি নেতা অধ্যাপক নন্দ বলছিলেন, ‘এরকম পরিস্থিতি হলে এমন নিয়ম করতে হবে, জার্মানির মতো, যেখানে বিকল্প সরকার না গড়তে পারলে চলতি সরকার ফেলে দেয়া যায় না।’

সংবিধান, নির্বাচন আইন সংশোধন করতে হবে
নির্বাচন কমিশন এবং আইন কমিশনও একইসাথে সারাদেশে ভোট করানোর পক্ষে থেকেছে, তবে এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে, একাধিক আইন, বিশেষ করে জন-প্রতিনিধিত্ব আইন, যার দ্বারা ভারতে ভোট নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটারও বদল আনতে হবে।

এর ওপরে দেশের অর্ধেক রাজ্যের আইনসভায়, অর্থাৎ ১৪টি রাজ্য বিধানসভাতেও একই সঙ্গে ভোট করানোর প্রস্তাব পাশ করিয়ে আনতে হবে।

তবে ১৪টি রাজ্য বিধানসভা থেকে এই প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিয়ে আসতে খুব একটা সমস্যা হবে না বিজেপির। কারণ তাদের নিজেদের অথবা সহযোগী দলগুলোরই সরকার আছে ১২টি রাজ্যে।

এর বাইরে উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র প্রদেশও নানা সময়ে বিজেপির দিকেই সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং ওই দু’টি রাজ্যের ভোট সাধারণত লোকসভা ভোটের সঙ্গেই হয়ে থাকে। এছাড়া আরো দুই-তিনটি রাজ্য এই প্রশ্নে বিজেপিকে সমর্থন দিয়ে দিতে পারে।

এরপরে সংবিধান সংশোধন বিল যখন সংসদে যাবে, নিম্ন-কক্ষ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বিজেপি সহজেই বিলটি পাশ করাতে পারবে। তবে রাজ্যসভায় যদি কংগ্রেস বিলের সমর্থনে না দাঁড়ায়, তাহলে বিল পাশ করানো কঠিন হবে।

সূত্র : বিবিসি