তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের আসল চিত্র কী?

তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের আসল চিত্র কী?

তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের আসল চিত্র কী?

তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৮২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা শনাক্তের পর বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, এটি পুরো ঘটনার ছোট একটি অংশ মাত্র। পাচারের আসল চিত্র আরও অনেক বড়।

প্রায় ছয় মাস ধরে তদন্তের পর বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা এটি শনাক্ত করলেও এই পাচারের ঘটনা ঘটেছে গত ছয় বছর ধরে। এই অর্থ পাচারের সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত বলে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, যাদের মধ্যে অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যোগসূত্রও তারা পেয়েছেন।

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে।

এর আগেও বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলোর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্যের দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানোর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়ে থাকে।তবে নমুনা পণ্যের নামে অর্থ পাচারের ঘটনা এর আগে শোনা যায়নি।অর্থ পাচারের ঘটনাকে ‘টিপ অব দ্যা আইসবার্গ’ বা মূল ঘটনার ছোট একটি অংশ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থ পাচারের পুরো চিত্রটি কতো বড়?

যেভাবে শনাক্ত হলো রপ্তানির নামে অর্থ পাচার

এই বছরের শুরুর দিকে রপ্তানির পর্যায়ে থাকা কয়েকটি পণ্যের চালান আটক করা হয়েছিল কাস্টমস হাউজে। তখন দেখা গেছে, টন টন পণ্য, ভালো কোয়ালিটির টিশার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট- এগুলো বাইরে গেলেও তার বিপরীতে কোন মূল্য দেশে আসছে না। কারণ বিক্রি করার সময় তারা এটাকে নমুনা বলছে।

সাধারণত তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রেতাদের কাছে পণ্যের নমুনা পাঠানো হয়, যাতে তারা ওই পণ্যটি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। এ ধরনের নমুনার পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা দেখতে পান, নমুনা বলে টনকে টন পণ্য জাহাজীকরণ করা হচ্ছে, যেখানে কোন মূল্য নেই। তখন তাদের সন্দেহ হয়। এরপর তারা যাচাই-বাছাই করতে শুরু করেন।সেই ঘটনা ধরে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তদন্ত শুরু করেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানকে তদন্ত করে এখন শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলো আসলে খুবই ছোট একটি অংশ। কিন্তু আসলে এইরকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের রপ্তানি করা পণ্য আর দেশে আসা টাকার হিসাব পর্যালোচনা করলেই এটি বেরিয়ে আসবে।শুল্ক গোয়েন্দারা তদন্ত করে তিন ধরনের অপরাধের প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন।

যেমন নমুনা পাঠানোর নামে পণ্য পাঠানো হয়েছে, অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানির অনুমতিপত্র জালিয়াতি করে পণ্য পাঠানো হয়েছে, আর যে মূল্যের পণ্য পাঠানো হয়েছে, তার চেয়ে কম মূল্য দেখানো হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান শেষের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।এজন্য জড়িত রপ্তানিকারক, যারা শুল্কায়নের সাথে জড়িত ছিলেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এতে অর্থ পাচারের মামলা করা হবে।

অর্থ পাচারের চিত্র আসলে কত বড়?

অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করেন, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে টাকা বেরিয়ে যায় দুইভাবে - একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার, আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। এমনকি অনেক সময় খালি কন্টেইনার যাওয়া আসা করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।

তবে শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তারা অভিনব একটি উপায় দেখতে পেয়েছেন। সেটা হলো ক্রেতাদের কাছে নমুনা হিসাবে পণ্য পাঠানোর কথা বলা হলেও আসলে তার মাধ্যমে টন টন পণ্য পাঠানো হয়েছে, যার কোন মূল্য দেশে আসেনি নি।শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তর তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের প্রাথমিক তথ্য জানালেও , সব মিলিয়ে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৮২১ কোটি টাকার বেশি বলে জানা যাচ্ছে। ২০১৭ সাল সালে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত এভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।

এই সময়ে মোট ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানের মাধ্যমে ৯১২১ টন পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া,কাতার, সৌদি আরব। এসব পণ্যের মূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা হলেও দেশে এসেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮২১ কোটি টাকাই পাচার হয়ে গেছে।শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তৈরি পোশাকের চালানের যে মূল্য রয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ কম মূল্য দেখানো হয়েছে।

এর আগে গত মার্চ মাসে ৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৮২ কোটি টাকার অর্থ পাচারের তথ্য জানিয়েছিল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তর। সেই সময় তারা বলেছিল, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তার বিপরীতে দেশে কোন অর্থই আসেনি।কিন্তু তাদের ধারণা, বাস্তবে অর্থ পাচারের চিত্রটি আসলে আরও অনেক বড়।

শুল্ক ও গোয়েন্দা পরিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক শামসুল আরেফিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’আমরা এখানে ১০টি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছি, বাস্তবে আরও এ ধরনের আরও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটা আসলে টিপ অব দ্যা আইসবার্গ, আমরা আইসবার্গের উপরের অংশটা দেখছি, কিন্তু ভেতরে আরও অনেক কিছুই রয়েছে, যা আমাদের একার পক্ষে তদন্ত করে দেখাও কঠিন।‘’এজন্য সব প্রতিষ্ঠানের হিসাব, ব্যাংকের ব্যাক টু ব্যাক এলসি, কি পরিমাণ পণ্য পাঠানো হয়েছে এবং বিনিময়ে কত টাকা আসছে, এসব যাচাই করে দেখা দরকার বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। সাত বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।বাণিজ্যের মাধ্যমে কারসাজি করে অর্থ পাচারের তালিকায় বিশ্বের ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল

তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। ফলে এই খাতের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফলে এসব খাতের রপ্তানি পণ্যে দ্রুত ছাড় দেয়া হয়, কড়কড়িও কম করা হয়। এরই সুযোগ নিয়েছে এই অপরাধী চক্রটি।

শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা শামসুল আরেফিন খানও বলছেন, ‘’সাধারণভাবে রপ্তানি করা পণ্যকে একটু বিশেষ চোখে দেখা হয় এবং প্রায়োরিটি ভিত্তিতে শুল্কায়ন করা হয়। কিন্তু যখন সেটা আন্ডারভ্যালু করা হয়, তখন দেশের ক্ষতি, কারণ দেশের সম্পদ গেলেও তার বিনিময়ে কিছু আসছে না। আর এখানে এমন উপায় নেয়া হয়েছে, যে দেশে কিছুই আসেনি।‘’এর আগেও বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের সময় রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক হওয়ায় এই খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দিকেই অতীতে অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে।

গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আশি হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। গত পাঁচ বছরে এভাবে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে।রপ্তানির সময় কম দাম দেখানোর ফলে বিদেশী ক্রেতারা যে অর্থ পরিশোধ করছে, তার একটি অংশ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসছে শুধুমাত্র সেই পরিমাণ অর্থ, যে পরিমাণ অর্থের কথা দেখানো হচ্ছে অর্থাৎ কাগজপত্রে যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটা।

সূত্র : বিবিসি