সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে কানাডা, নালিশ জয়শঙ্করের

সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে কানাডা, নালিশ জয়শঙ্করের

সংগৃহীত

ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের জন্য নিরাপদ ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে উঠছে কানাডা, যা দিন দিন দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলছে নয়াদিল্লির। যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক সংস্থা হাডসন ইনস্টিটিউটকে দেওয়া এক বক্তব্যে এই নালিশ জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।

শুক্রবার হাডসন ইনস্টিটিউটে বক্তব্য দেন জয়শঙ্কর। তার বক্তব্য শেষে একজন সাংবাদিক কানাডার সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক টানাপোড়েন নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কানাডার প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি কিছু অভিযোগ করেছেন। এর আগে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন, সম্প্রতি জনসমক্ষে তা প্রকাশ করেছেন।’

‘আমরা তাকে বলেছি— যে অভিযোগ তিনি তুলেছেন, তা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির মধ্যে পড়ে না। তারপরও যদি অভিযোগের পক্ষে তার কাছে যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকে এবং সেসব যদি তিনি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন, আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারটি দেখব।’

‘কিন্তু সমস্যা হলো, দীর্ঘদিন ধরে কানাডা এমন সব লোকজনকে আশ্রয় দিচ্ছে, যারা অপরাধী ও সন্ত্রাসনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। আমাদের দূতাবাসে তারা হামলা করছে, দূতাবাসকর্মীদের প্রকাশ্যে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, মানবপাচার, সহিংসতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস তৎপরতা— এ সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত এই অপরাধীরা। এমনকি সুদূর কানাডায় বসে তারা ভারতে তাদের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক চালাচ্ছে এমন তথ্যও রয়েছে।’

‘কানাডা দিন দিন সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। আপনাদের, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নাগরিকদের জন্য হয়তো এ ব্যাপারগুলো খানিকটা ভিন্ন, কিন্তু এই সন্ত্রাসীদের কারণে ভারত যে ভুক্তভোগী— এটা পুরোপুরি সত্য। আমি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকেও এসব কথা জানিয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

কানাডার নাগরিক ও সেখানকার শিখ ধর্মাবলম্বীদের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক টানাপোড়েন চলছে কানাডা ও ভারতের মধ্যে। দুই মিত্র রাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্বে অস্বস্তিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা কানাডাকে সহায়তা করার জন্য ভারতকে আহ্বান জানিয়েছে।

জয়শঙ্করের শুক্রবারের বক্তব্যের মাধ্যমে এই ইস্যুতে ভারতের অবস্থান আরও একবার স্পষ্ট হলো।

গত জুনে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের রাজধানী ভ্যানকুভারে একটি গুরুদুয়ারার (শিখ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়) সামনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হরদীপ সিং নিজ্জর ছিলেন দেশটিতে বসবাসকারী শিখদের একজন নেতা। ১৯৭৭ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধর জেলা থেকে কানাডা গিয়েছিলেন হরদীপ, পরে সেখানাকার নাগরিকত্বও অর্জন করেন তিনি।

এদিকে, শিখদের ঘোষিত রাষ্ট্র খালিস্তান কায়েমের জন্য তৎপর দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠী খালিস্তান টাইগার ফোর্স এবং শিখস ফর জাস্টিস কানাডা শাখার একজন জ্যেষ্ঠ নেতা হরদীপ ছিলেন ভারতের একজন তালিকাভুক্ত ফেরার আসামি। হরদীপকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করাতে আগ্রহী ছিল ভারত।

বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার কারণে খালিস্তান টাইগার ফোর্স এবং শিখস ফর জাস্টিস— দুই সংগঠনই ভারতে নিষিদ্ধ; তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বেশ সক্রিয় খালিস্তান টাইগার ফোর্স এবং শিখস ফর জাস্টিস।

ভারতের পরেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিখ বসবাস করেন কানাডায়। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশই শিখ।

বিগত কয়েক বছরে ভারতের একাধিক আহ্বান সত্ত্বেও খালিস্তান টাইগার ফোর্স এবং শিখস ফর জাস্টিসের কর্মকান্ডে কখনও বাধা দেয়নি কানাডার সরকার। এই ইস্যুতে দেশটির বক্তব্য— যেহেতু কানাডার সংবিধানে শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনকে বৈধ, তাই এক্ষেত্রে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয় সরকারের পক্ষে।

ভারতের সঙ্গে কানাডার সাম্প্রতিক যে দ্বন্দ্ব, তার সূত্রপাত এখান থেকেই। গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনেও দুই দেশের শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের আঁচ পাওয়া গিয়েছিল।

জি-২০ সম্মেলন শেষে নয়াদিল্লি থেকে ফেরার এক সপ্তাহ পর, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮ সেপ্টেম্বর কানাডার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে ট্রুডো বলেন, তার দেশের গোয়েন্দারা হরদীপ হত্যায় ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেয়েছেন।

কানাডার জন্য এই ঘটনাটি যে তীব্র অবমাননাকর, তা বোঝাতে গিয়ে পার্লামেন্ট ভাষণে ট্রুডো বলেন, ‘কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।’

ভারতের সরকারের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীন, মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যেভাবে কাজ করে, এই ঘটনা (হরদীপ হত্যা) সেই মৌলিক নিয়মনীতির পরিপন্থী।’

ট্রুডো পার্লামেন্টে এই অভিযোগ তোলার পরদিনই কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিসি উইং (র) কানাডা শাখার প্রধানকে বহিষ্কারাদেশ দেয় কানাডীয় সরকার।

এদিকে ট্রুডোর এই বক্তব্যের পর থেকে নজিরবিহীন টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়েছে কানাডা ও ভারত। নয়াদিল্লি এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছে, সেই সঙ্গে ট্রুডোর বক্তব্য এবং ভারতীয় শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষুব্ধ ভারত পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পরের দিনই দিল্লির কানাডা দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে।

সূত্র : এনডিটিভি