আফগানিস্তানে পাকিস্তানি তালেবান কমান্ডারদের ওপর রহস্যজনক হামলা বাড়ছে কেন?

আফগানিস্তানে পাকিস্তানি তালেবান কমান্ডারদের ওপর রহস্যজনক হামলা বাড়ছে কেন?

আফগানিস্তানে পাকিস্তানি তালেবান কমান্ডারদের ওপর রহস্যজনক হামলা বাড়ছে কেন?

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানরা ২০২১ সালের অগাস্টে ফিরে আসার পর থেকেই সেদেশে নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) কমান্ডারদের ওপর হামলা বাড়ছে।

বিবিসি মনিটরিং পাকিস্তান ও আফগান গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি দেখে জানতে পারছে যে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের হামলায় টিটিপির ১৮ জন কমান্ডার নিহত বা আহত হয়েছেন।পাকিস্তানের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, এ ধরণের সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে গত ১২ই সেপ্টেম্বর, যাতে আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে আইইডি বিস্ফোরণে টিটিপি প্রধান মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাদশাহ খান মেহসুদ নিহত হয়েছেন।

একই প্রদেশের আরেক সিনিয়র টিটিপি কমান্ডার আহমেদ হুসেন ওরফে ঘাট হাজি গত ২৫শে অগাস্ট মারা যান।ঘটনাচক্রে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিটিপি এই টার্গেট কিলিংগুলির খবর নিশ্চিতও করেনি আবার অস্বীকারও করেনি। তালেবানরা কাবুল দখল করার মাস চারেক পর থেকেই এধরনের হামলা শুরু হয়।

দায় কেউ স্বীকার করেনি

পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী বা কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠীই এইসব হামলার দায় স্বীকার করেনি।টিটিপির-র অন্তত ১৮ জন কমান্ডার ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত নিহত বা আহত হয়েছেন।

এই কমান্ডাররা টিটিপির পাঁচটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পূর্বতন জামাত-উল-আহরার গ্রুপের আটজন, সোয়াত ও মেহসুদ গ্রুপের তিনজন করে, বাজৌরের দুজন এবং ডারা আদম খেল গোষ্ঠীর একজন।গিলগিট-বালতিস্তানের বাসিন্দা টিটিপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র মুফতি খালিদ বুল্তিকেও নিশানা করা হয়েছিল। তিনি করাচিতে পাকিস্তানি তালেবানে যোগ দিয়েছিলেন।

পাকিস্তান সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের চারটি প্রদেশে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। নানগরহরে আটটি, কুনারে পাঁচটি, চারটি পাকতিকায় এবং কান্দাহারে একটি হামলা হয়েছে।আইইডি বিস্ফোরণ, নিশানা করে হত্যা, অপহরণ এবং বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে এইসব হত্যা করা হয়েছে।

এ বছর যত হামলা

হামলার সাম্প্রতিকতম শিকার হলেন বাদশাহ খান মেহসুদ এবং আহমেদ হুসেন ওরফে ঘাট হাজী।গত ১৫ই জুলাই কাবুল-ভিত্তিক আফগান ইসলামিক প্রেস নিউজ এজেন্সি বিভিন্ন সূত্র উদ্ধৃত করে জানায় যে, নানগরহর প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদে টিটিপি নেতা মুফতি নূর ওয়ালি মেহসুদের ওপর হামলা হয়েছে এবং তার কয়েকজন দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন।তবে তালেবান পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র আবদুল বাসির জাবুলি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন যে ওই প্রদেশে টিটিপির কোনও উপস্থিতিই নেই।

এর আগে গত ২০শে জুন 'দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন' পত্রিকায় লেখা হয়, নানগরহরে টিটিপি কমান্ডার সারবাকাফ মুহম্মদকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে। জামাত-উল-আহরারের সিনিয়র কমান্ডার মি. মুহাম্মদ গত ৩০শে জানুয়ারি পেশোয়ার পুলিশ লাইন্সের মসজিদে যে আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল, তার দায় স্বীকার করেছিলেন ।বেসরকারি সংবাদ চ্যানেল জাভিয়া নিউজও মি. মুহাম্মদের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে বলেছে যে আফগান তালেবানের দুজন সদস্য, যারা টিটিপিতে যোগ দিতে সীমান্ত অতিক্রম করতে চেয়েছিলিনে, তারা কাবুল এবং ময়দান ওয়ারদাগ প্রদেশে রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন।

পাকিস্তানি গণমাধ্যমে যা বলা হচ্ছে

নানগরহরের সীমান্তবর্তী জেলা লালপুরায় গত ২৫শে জুন এক আইইডি হামলায় জামাত-উল-আহরারের আরও দুই কমান্ডার ক্বারী ইমরান ওরাকজাই ও আতিফ মুহাম্মদ গুরুতর আহত হন।

জুলাই মাসে টিটিপির তিন কমান্ডার তারিক সোয়াতি, মুহম্মদ দাউইজাই ও সফদরকে পৃথক হামলায় নিশানা করা হয়েছিল।পাকিস্তানি প্রশাসনের মতে সেদেশের খাইবার পাখতুনখোয়ার দাসু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে চীনা প্রকৌশলীদের ওপরে যে আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল ২০২১ সালের ১৪ই জুলাই, তার মূল চক্রী ছিলেন মি. সোয়াতি।তিনি টিটিপির সোয়াত গ্রুপের সদস্য ছিলেন এবং ২০২৩ সালের ১০ই জুলাই কুনার প্রদেশে নিহত হন।

পাকতিকা ও নানগরহর প্রদেশে পৃথক দুটি হামলায় গত ১৪ই জুলাই মি. জাওয়াইজাই নিহত ও ২০শে জুলাই মি. সফদর আহত হন।পাকিস্তানি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, গত ১৭ই অগাস্ট নানগরহরের লালপুরা জেলায় বিমান হামলায় নিহত হন জামাত-উল-আহরার। অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয় যে তিনি আইইডি বিস্ফোরণে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন।

আগের হত্যাকাণ্ড

তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পর সবথেকে বড় হত্যাকাণ্ডের খবর আসে ২০২২ সালের ১০ই জানুয়ারি, যাতে টিটিপির মুখপাত্র মুফতি খালিদ বুল্তি নিহত হন।পাকিস্তান সীমান্তের কাছে নানগরহর প্রদেশে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আফগান সরকার ও মার্কিন বাহিনীর হাতে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ধরা পড়েন তিনি। কিন্তু যখন তালেবানরা ফিরে আসার পরে তিনি এবং তার কয়েকশো টিটিপি সদস্যকে মুক্তি দেওয়া হয়।

মি. বুল্তিকে প্রতিবেশী কুনার প্রদেশে দাফন করার সময়ে কয়েকশো টিটিপি সমর্থক হাজির হয়েছিলেন।‘উমর মিডিয়া’তে টিটিপির মুখপাত্র মুহম্মদ খুরাসানি তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়েছিল যে মি. বুল্তির মৃত্যু হয় নয়ই জানুয়ারি তারিখে।

দ্বিতীয় হামলা হয় ২০২২ সালের ১৯ই জানুয়ারি, যেদিন কুনারে একটি আইইডি বিস্ফোরণে তার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই হামলায় সিনিয়র কমান্ডার মুফতি বুরজান মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তার এক সহকর্মী মারা যান।মি. বুরজান টিটিপির দক্ষিণাঞ্চলের মিলিটারি কমিশনের প্রধান ছিলেন।কুনার এবং পাকতিকা প্রদেশে গত সাতই আগস্ট দুটি পৃথক হামলায় আরও দুজন কমান্ডার নিহত হন।

টার্গেট কিলিং ?

টিটিপির প্রভাবশালী কমান্ডার এবং জামাত-উল-আহরার গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা উমর খালিদ খুরাসানি ও তার এক সহযোগী পাকতিকা প্রদেশে ও কুনারে এক অন্য আইইডি বিস্ফোরণে উকাবি বাজোরি নিহত হন।টিটিপির মুখপাত্র মুহম্মদ খুরসানি নয়ই অগাস্ট জারি করা এক বিবৃতি দিয়ে ওই দুজনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেন ।

খুন হওয়া টিটিপির কমাণ্ডারদের মধ্যে উমর খালিদ খুরাসানিই সবথেকে উঁচু পদে আসীন ছিলেন।জামাত-উল-আহারের গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত দুই টিটিপি কমাণ্ডার বিসমিল্লাহ ওরফে আসাদুল্লাহ পহেলওয়ান আর মুদাসিন ইকবাল নিহত হন ২০২২ সালে ছয়ই অক্টোবর।কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোল্ডাক জেলায় মি. পহেলওয়ানকে নিশানা করে খুন করা হয়। অন্যদিকে মি. ইকবালকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা নানগরহর থেকে অপহরণ করে এবং পরে তার মৃতদেহ রাস্তার পাশে পাওয়া যায়।

সোয়াত গ্রুপের টিটিপি কমান্ডার সইফুল্লাহ বাবুজিকে নানগরহারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ২০২২ সালের ১৭ই নভেম্বর । তিনি টিটিপির উপপ্রধান মুফতি মুজাহিমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।কুনার প্রদেশে ২০২২ সালের নয়ই অক্টোবর এক আইইডি বিস্ফোরণে টিটিপি বাজৌর গোষ্ঠীর কমান্ডার আবদুল্লাহ বাজৌরি গুরুতর আহত হন।ওই একই প্রদেশে ২০২৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এক আইইডি বিস্ফোরণে জামায়াতুল আহরার গোষ্ঠীর আরেক কমান্ডার শামশির মুহম্মদ, তার কন্যা ও চারজন সহযোগী নিহত হন।

টিটিপি'র নীরবতা

বিবিসি মনিটরিংয়ের সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী টিটিপির মুখপাত্র মুহম্মদ খুরাসানি মাত্র তিনজন কমান্ডারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদের মধ্যে মি.বুল্তি, উমর খালিদ খুরাসানি এবং মি. উকাবির খুন হওয়ার ঘটনাগুলো আছে। বাকি হামলা ও নিশানা করে হত্যার ঘটনাগুলি মি.খুরাসানি নিশ্চিতও করেন নি, আবার অস্বীকারও করেননি।আফগানিস্তানে যে টিটিপির অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা আড়াল করার জন্যই হয়তো এই নীরবতার নীতি নিয়েছে তারা।পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ২০২২ সালের শেষের দিকে সমঝোতার পর থেকেই টিটিপি কঠোরভাবে এই নীতি অনুসরণ করেছে। সেই আলোচনা হয়েছিল কাবুলে। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে টিটিপির শেষ বৈঠক হয় ২০২২ সালের ২৬শে জুলাই।

পাকিস্তানী গুপ্তচরদের যোগ?

সর্বশেষ যে বার্তা টিটিপি তাদের কমাণ্ডারদের পাঠিয়েছে ১৪ই সেপ্টেম্বর, সেখানে বলা হয়েছে যে সংগঠনে আফগানদের যেন নেওয়া না হয়।ওই বার্তায় বলা হয়েছে যে "সব ‘শ্যাডো গভর্নর’কে কঠোরভাবে জানানো হচ্ছে যে তারা যেন সংগঠনে কোনও আফগানকে নিয়োগ না করে। (এই নির্দেশ) লঙ্ঘন করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কাউকে অভিযোগ জানানোর সুযোগও দেওয়া হবে না।“

এই হত্যাকাণ্ডগুলির পেছনে কারা রয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয় এবং হামলাকারীদের ব্যাপারে খুব কম তথ্য রয়েছে।তবে টিটিপির অনেক সমর্থক এই সব হত্যাকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থাকে দায়ী করছেন।উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের অগাস্টে মি. খোরাসানির মৃত্যুর পরে টিটিপি সমর্থকরা পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থাকে দোষারোপ করেছিল।তারা টিটিপি'র সঙ্গে যোগাযোগ রাখ সব পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি করেছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ করেছিলেন।

সূত্র : বিবিসি