লিবিয়ায় জিম্মি সাতক্ষীরার ১০ যুবক, কারাগারে ২০

লিবিয়ায় জিম্মি সাতক্ষীরার ১০ যুবক, কারাগারে ২০

সংগৃহীত

ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ১০ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি করে দফায় দফায় টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে মানবপাচারকারী একটি চক্রের বিরুদ্ধে। টাকা দিতে রাজি না হলে কিংবা দেরি হলে ঐ যুবকদের নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হচ্ছে স্বজনদের মোবাইলে। এ ছাড়া ঐ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে নৌপথে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় মাল্টা সাগর থেকে আবারও লিবিয়া ফিরে আসা আরো ২০ যুবককে আটক করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।

ভুক্তভোগী পরিবার, স্থানীয় একাধিক সূত্রসহ ও মানবপাচার চক্রের কয়েক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের দেলোয়ার কয়াল, মামুন কয়াল, তারানীপুরের আবু রায়হান, বংশীপুরের মিলন, কৈখালীর আনারুল মিস্ত্রি, রহিম সরদার, মিঠু কয়াল, পূর্ব কৈখালীর জামির আলী জাম, আব্দুল কাদের ও রাসেল হোসেন জিম্মি হয়েছে আছেন।

এ ছাড়া শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর গ্রামের আবু জাফরের ছেলে সালামিন হোসেন, মানিকখালী গ্রামের নুর আমিনের ছেলে শাহাজান হোসেন ও কালিঞ্চি এলাকার জাকির আলীর ছেলে শেখ আসমতসহ ২০ যুবককে আটক করেছে লিবিয়া পুলিশ। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয়সূত্র থেকে জানা যায়, মানবপাচার চক্রটির মূলহোতা শ্যামনগর উপজেলার শ্রীফলকাঠি গ্রামের হারুন-অর রশিদ। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন ভগ্নিপতি মনিরুল ইসলাম এবং ধুমঘাট গ্রামের সেকেন্দার ও মুরাদ হোসেন। স্থানীয়ভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে সেকেন্দারসহ হারুনের কয়েকজন আত্মীয়। হারুন ঢাকায় এবং মনিরুল ও মুরাদ লিবিয়ায় অবস্থান করে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে। আট থেকে নয় লাখ টাকায় সাগর পথে ইতালি পৌঁছে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যুবকদের লিবিয়ায় নিয়ে যায় তারা। পরে ভালো নৌযানে তুলে দেওয়াসহ নানা অজুহাতে আর দুই থেকে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এ চক্রটি। পাশাপাশি অনেককে লিবিয়ায় সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি পর্যন্ত করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জিম্মি যুবকদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে মানবপাচারকারী চক্রের প্রধান হারুন ও তার ভগ্নিপতি মনিরুলের সহায়তায় লিবিয়াতে মামুন, দেলোয়ার, আবু রায়হান, মিলন, আনারুল, আব্দুর রহিম, মিঠু, ও জামির আলী জামুকে আটকে রাখা হয়েছে। তিন দফায় ১২ থেকে সাড়ে ১৩ লাখ করে টাকা পরিশোধের পরও অতিরিক্ত টাকা দাবি করে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

সালামিন হোসেনের বাবা আবু জাফর জানান, জমি বন্ধক দিয়ে তিন লাখসহ মাজাট গ্রামের নুর মোহাম্মদ ও প্রভাষ কর্মকারের কাছ থেকে চড়া সুদে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে মোট ৮ লাখ টাকা চক্রটিকে দেয়। অথচ ইতালিতে ছেলেকে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। বরং গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ার কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তার ছেলে।

আরেক কারাবন্দি শাহাজানের বাবা নুর আমিন জানান, শেষ সম্বল চাষের জমি বিক্রি করে হারুনের ‘টোপে’ পড়ে ছেলেকে ইতালি পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। কারাবন্দি হওয়ার পর তাকে ছাড়ানোর অজুহাতে হারুনের লোকজন এক লাখ, দেড় লাখ করে টাকা দাবি করছে। সকালে ও সন্ধ্যায় শুধু দুই বার খেতে দেওয়ার কথা জানিয়েছে তার ছেলে। এ দিকে গত কিছুদিন ধরে হারুনের মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি তা রিসিভ করছেন না।

মামুন কয়ালের বাবা জাহার আলী কয়াল জানান, প্রায় একমাস আগে ১০ যুবকের নির্যাতনের একটি ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। সে ভিডিটিওতে বাড়ি থেকে ‘টাকা পাঠাও, টাকা পাঠাও’- এমন কাকুতি মিনতি করতে দেখা যায় মামুনসহ অন্যদের। ওই ভিডিও এলাকায় ভাইরাল হলে পাচারচক্রের সদস্যরা বেকায়দায় পড়ে জিম্মি যুবকদের দিয়ে নুতন একটি ভিডিও তৈরি করে পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। তাতে মামুনসহ অন্যদের বলতে শোনা যায়, ‘সাংবাদিক ভাই, আপনারা এ বিষয়ে কোনো নিউজ করবেন না, আমরা ভাল আছি। তবে মামুন ও আরও একজনের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গত সোমবার নুতন করে আরেকট একটি ভিডিও পাঠানো হয়। সেটাতে মামুনসহ অন্যদের টাকা চাইতে দেখা যায়।

রাসেলের বাবা আব্দুর রশিদ জানান, জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করার অজুহাতে গত বুধবার প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে হারুন ও তার লোকজন মাথাপিছু এক লাখ করে টাকা আদায় করে। তার বোন ও ভগ্নিপতি মনিরুলের ভাই সেকেন্দারের বিকাশে এসব টাকা দিতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।

এ সব বিষয়ে অভিযুক্ত হারুন-অর রশিদ জানান, কয়েকজনকে গত মাসে নৌকায় তুলে দেওয়া হলেও মাল্টা সাগর উত্তাল থাকায় তারা ফিরে আসে। আর কারাগারে থাকা ২০ জনকে মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

তারা কাউকে জিম্মি করেননি দাবি করে পাচার চক্রের এ হোতা আরও জানান, তার ভগ্নিপতি মনিরুলের আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েকজনকে লিবিয়ার সন্ত্রাসী আটক করে মুক্তিপণ চাচ্ছে। সেখানকার সহযোগীদের সহায়তায় জিম্মিদশা থেকে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের কেউ এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ করেনি।