বিএনপির ‘মহাযাত্রা’য় কী হবে? আর আওয়ামী লীগ কী করবে?

বিএনপির ‘মহাযাত্রা’য় কী হবে? আর আওয়ামী লীগ কী করবে?

বিএনপির ‘মহাযাত্রা’য় কী হবে? আর আওয়ামী লীগ কী করবে?

বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি আগামী ২৮শে অক্টোবরের পর ‘মহাযাত্রা’র ঘোষণা দেয়ার পর, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে ‘পরিস্থিতি মোকাবেলা’র জন্য তারাও এখন প্রস্তুত।আগামী মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।

দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, এ তফসিল ঘোষণার সময়টিকে লক্ষ্য করেই নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী পরস্পরকে মোকাবেলার জন্য সব ধরণের প্রস্তুতিই নিচ্ছে উভয় দল।

আবার সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে সংলাপসহ যে পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে, তা নিয়েও দল দুটির অবস্থান এখন বিপরীত মেরুতে।

আওয়ামী লীগ বলছে, সংলাপ চাইলে বিএনপিকে ‘সরকারের পদত্যাগ কিংবা পতনের’র সব কর্মসূচি প্রত্যাহার’ করতে হবে আগে। আর বিএনপি বলছে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।ওদিকে হঠাৎ করে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মীর গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা চলছে।

একই সঙ্গে বিএনপি অভিযোগ করেছে যে, বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা নিশ্চিত করতে ‘মিথ্যা মামলায় সাজা’ দেয়া হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, দুটি প্রধান দলের কথাবার্তায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এগিয়ে আসার সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সহিংসতাময় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

'মহাযাত্রা'র মানে কী

ঢাকায় বুধবারের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮শে অক্টোবরে নতুন করে মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেছেন, ওই কর্মসূচি থেকে তাদের ‘মহাযাত্রা’ শুরু হবে, এবং এরপর সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা আর থামবেন না।এরপর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়েছে যে, নতুন মহাযাত্রা মানে কী।কারণ বিএনপি অনেক দিন ধরেই সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে একের পর এক কর্মসূচি পালন করে আসছিলো।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কয়েকজন বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘মহাযাত্রা’ বলতে আসলে বোঝানো হয়েছে এমন কর্মসূচি, যা দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া কোন একতরফা নির্বাচনকে ঠেকানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সরকার এখন প্রতিদিন নতুন পুরনো মামলায় বিএনপি নেতাদের জেলে পাঠানোর শুরু করেছে।

“আমরা এতদিন শুধু প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এখন সরকারকে থামাতে হবে। এই থামানোর জন্য যা যা করার দরকার, সেটাই মহাযাত্রা,” বলছিলেন তিনি।জানা গেছে, দলটি ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকেই অবরোধ-ঘেরাও-অবস্থান এর মতো ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করে ঢাকায় বড় ধরণের শো-ডাউনের পরিকল্পনা করছে।

এর আগে ওই সমাবেশে অংশ নিতে সারাদেশ থেকেই নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।তবে বিএনপি এ ধরণের সম্ভাব্য কর্মসূচির বিষয়গুলো নিয়ে আগে থেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বিরোধী দলকে 'হেফাজতের মতো শাপলা চত্বরে অবস্থানের চেষ্টা' কিংবা 'ঢাকায় অবরোধ কর্মসূচি'র মতো বিষয় গুলো নিয়ে শক্ত ভাষায় হুঁশিয়ার করে বক্তব্য দিয়েছেন।বুধবারও বায়তুল মোকাররমের সমাবেশ থেকে বিএনপিকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, “ওরা (বিএনপি) অবরোধ করবে। আমরাও পাল্টা অবরোধ করবো ওদের। দাঁড়াতেই দিবো না।”

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বিএনপি যাই করুক, জাতি এখন ‘নির্বাচন যাত্রায়’ আছে এবং সময়মত নিয়ম অনুযায়ী উৎসবমুখর পরিবেশে সে নির্বাচন হবে।“জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কেউ বাধা দেয়া বা সহিংসতার চেষ্টা করলে আমরাও এখন প্রস্তুত আছি,” বলছিলেন তিনি।

অথচ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে দল দুইটির মধ্যে বেশ নমনীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। এমনকি মূলত এরপর থেকেই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বাধাহীনভাবে সভা সমাবেশ করে আসছিলো।পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ অনেকটা দৃশ্যমান থাকায় অনেকে পরিস্থিতি পরিবর্তনেরও আশা করছিলেন।

গ্রেফতার ও সাজা প্রসঙ্গ

বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার জনসভায় অভিযোগ করেছেন, ওই সমাবেশের আগের দিনই দলের নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ আড়াইশো নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে।

এছাড়াও তার অভিযোগ সরকার ‘মিথ্যা মামলায় সাজা' দিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার চেষ্টা করছে।তবে বুধবারই সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস, অস্ত্র ও খুনসহ যারা বিভিন্ন মামলায় আগে থেকে জড়িত; সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

তিনি বলেছেন, “তবে নতুন করে গ্রেফতারের কোন পরিকল্পনা সরকারের নেই।”এদিকে, বিএনপির দপ্তর সেল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৮শে জুলাই থেকে ১২ই অক্টোবর পর্যন্ত দলটির বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে ৩৪৩টি মামলা হয়েছে, যাতে ১৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

এছাড়া গত কয়েক মাসে বেশ কিছু মামলায় দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নানা ধরনের সাজা দিয়েছে আদালত।দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে নয় বছর, ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমান ১৩ বছর, প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে মোট ৭০ বছরসহ বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি।

এছাড়া সম্প্রতি আটক করা হয়েছে দলের নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এবং শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকেও।বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান আগেই বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণার পর মামলা ও গ্রেফতার বেশ কিছুদিন খুব একটা দেখা যায়নি। এখন আবার এটি বেড়েছে বলে মনে করেন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।“সরকার প্রতিদিন গায়েবী মামলা করে নেতাকর্মীদের আটক করছে। ইচ্ছে মতো সাজা দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো করছে ইচ্ছেমতো আরেকটি নির্বাচন করে নেয়ার জন্য। কিন্তু সেটি আমরা হতে দিবো না,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।

সংলাপের সম্ভাবনা নেই?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় এসে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর ওয়াশিংটনে ফিরে যে সুপারিশমালা প্রকাশ করেছে তার প্রথমেই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যুতে সংলাপের বিষয়টি।কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুই প্রধান দলের কোন পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে তেমন কোন বক্তব্য আসেনি।

বরং আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলে আসছে যে, তাদের ভাষায় ‘যারা ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা’ ঘটিয়েছে, কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘আগুন সন্ত্রাস’ করেছে, তাদের সাথে কোন ধরণের আলোচনায় তারা উৎসাহিত নয়।যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে অনেকে আশা করেছিলেন যে হয়তো নির্বাচন নিয়ে একটি সংলাপের পরিবেশ তৈরি হতেও পারে।

আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রহমান বলছেন, “সংলাপ চাইলে বিএনপিকে সব কর্মসূচি ও দাবি প্রত্যাহারের ঘোষণা আগে দিতে হবে। এরপর সরকার বিবেচনা করবে সংলাপের প্রয়োজন আছে কি-না”।অন্যদিকে, বিএনপির আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, “সরকারের কারণেই নির্বাচন নিয়ে এমন অনাস্থার তৈরি হয়েছে। তাই তাদের ক্ষমতায় রেখে তো সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না। তাদের পদত্যাগের পর কীভাবে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সংলাপ হতে পারে।”

অর্থাৎ সংলাপ নিয়ে কার্যত আওয়ামী লীগের যেমন উৎসাহ নেই, তেমনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেও সংলাপে যেতে রাজী নয় বিএনপি।রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ভিসা নীতির কারণে দলগুলোকে কিছুদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে নমনীয়তা দেখাতে দেখা গেলেও, এখন আবার তারা তাদের অনড় অবস্থানেই ফিরে গেছে।“এখন বিএনপি রাজপথেই ফয়সালা করতে চাচ্ছে আর আওয়ামী লীগও দমন করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই মনে হয় পরিস্থিতি আসলে সহিংসতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি