বিশ্বকাপে বাবর, শাদাব আর হারিসের কী হলো?

বিশ্বকাপে বাবর, শাদাব আর হারিসের কী হলো?

পাকিস্তান পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক- বাবর আজম

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩ এ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান নিজেদের পঞ্চম ম্যাচ খেলতে আজ মাঠে নামছে।বলা যায়, আফগানিস্তানের জন্য চলতি টুর্নামেন্ট একটা উত্থান পতনের বিশ্বকাপ যাচ্ছে।বাংলাদেশের বিপক্ষে হার দিয়ে শুরু করা আফগানিস্তান এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক জয় দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।এই দলটিই আবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষ ১৫০ রানও স্পর্শ করতে পারেনি।পাকিস্তানের অবস্থাও কাছাকাছি তবে তারা ইতোমধ্যে বিশ্বকাপের মাঠে দুটি জয় তুলে নিয়েছে।

নেদারল্যান্ডস এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়, এবং অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের বিপক্ষে হার- এই হলো এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের বিশ্বকাপ।পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ম্যাচ নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার শোয়েব আখতার বলেছেন, “আফগানিস্তান পাকিস্তান ম্যাচে উত্তেজনা থাকবে। আফগানিস্তান এখন ভালো দল, পাকিস্তানের সাথে লড়াই করবে। পাকিস্তানের চেয়ে ভালো স্পিনার আছে আফগানিস্তানের দলে।”

তিনি বলেন, পাকিস্তান আফগানিস্তানের বিপক্ষ হারলে সেটা হজম করার মতো হবে না।চেন্নাইয়ের উইকেটে স্পিন খেলা নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন এই সাবেক ফাস্ট বোলার।দলটির পারফর্মারদের হঠাৎ হারানো ফর্ম এখন পাকিস্তানের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাবর আজম কীভাবে আউট হচ্ছেন?

বাবর আজম এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত পাঁচ, ১০, ৫০ এবং ১৮ রান করেছেন চার ম্যাচে।গড়পড়তা ব্যাটারের জন্য ঠিকঠাক স্কোর, কিন্তু যার ওয়ানডে গড় ৫৬ এবং যে ক্রিকেটার নিজ দলের ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত তার ব্যাটে এই রান বেমানান।আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের এক নম্বর ব্যাটার বাবর আজম আউটও হচ্ছেন অদ্ভুত সব উপায়ে।

যেমন অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার প্রায় গুড লেন্থে থাকা একটা বল মিড উইকেটে পাঠানোর সময় প্যাট কামিন্সের হাতে ক্যাচ দেন বাবর।‘ক্যাচ তুলে দেন’ এই কথাটাও হয়তো ভুলই হবে, কারণ প্যাট কামিন্স দারুণ বিচক্ষণতায় ক্যাচটি লুফে নিয়েছেন।

এর আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক হাঁকানোর পরপরই মোহাম্মদ সিরাজের বলে বোল্ড হয়ে যান।অনেকটা থার্ড ম্যানের দিকে বল পাঠানোর চেষ্টায় তিনি বল মিস করেন এবং সিরাজ তাকে পরাস্ত করে একটা উইকেট নিয়ে নেন।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে রীতিমতো উইকেটে হাঁসফাঁস করছিলেন বাবর আজম, ১৮ বল খেলে মাত্র পাঁচ রান নিতে পারেন তিনি।পরে কলিন অ্যাকারম্যানের বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন।সেটা ছিল চলতি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের প্রথম ম্যাচ।নের বলে তিনি আউট হয়েছেন সেটাই হয়তো বাবর আজমকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেবে।

লেগ স্ট্যাম্পের বল পা থেকে খানিকটা দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বলে খোচা দেন তিনি এবং সেটা উইকেট কিপারের হাতে গিয়ে জমা হয়।এরপর ১৫ বল খেলে ১০ রান নেয়া বাবর এদিন শ্রীলঙ্কার দিলশান মধুশানাকার সবচেয়ে নিরীহ বলটাতেই উইকেট দিয়ে এসেছেন।এখনও পর্যন্ত বাবর আজম এই বিশ্বকাপে একজন অফস্পিনার, একজন বাহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার, একজন ডান হাতি ফাস্ট বোলার এবং একজন লেগস্পিনারের কাছে উইকেট দিয়ে এসেছেন।

কোনও সুনির্দিষ্ট ঘরানার বোলারের বলে আউট হননি তিনি, তবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে স্পিন বলে ভুগছেন। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে স্পিন বলে বাবরের স্ট্রাইক রেট ৭০, ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত যা ছিল ৮২।গত দুই বছরে বাবর ৩৯ বার স্পিনারদের বলে আউট হয়েছেন, ক্যারিয়ারের আগের ছয় বছরে আউট হয়েছিলেন ৪৭ রান।

জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফো বলছে, বাবর আজম ২০২৩ সালের আগে তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে একবার মাত্র স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হয়েছেন, ২০২৩ সালেই হয়েছেন তিনি চারবার।অর্থাৎ স্পিন বলে বাবর আজম যে খানিকটা ভুগছেন এটা স্পষ্ট।বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে বাবর আজমের পারফরম্যান্স যে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ হবে এটুকু বলার অপেক্ষা রাখে না।তবে বাবর আজম এখনো পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে যা করেছেন তা অসামান্য এবং দুর্দান্ত।

শাদাব খান নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন?

মাত্র কদিন আগেও শাদাব খানকে মনে করা হচ্ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ নেতা।তিনি বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচ খেলেই একাদশে জায়গা হারিয়েছেন।শাদাব খান এবং মোহাম্মদ নাওয়াজ মাঝের ওভারগুলোতে পাকিস্তানের বোলিংয়ের দায়িত্বে থাকেন।

কিন্তু চলতি বিশ্বকাপে এই দুজনই মোটাদাগে ব্যর্থ এখনও পর্যন্ত।মাঝের ওভারগুলোতে ছয়ের ওপরে রান দিচ্ছে পাকিস্তান এবং উইকেট নিতেও তাদের বেশ ভুগতে হচ্ছে।শাদাবের বলে যেন ব্যাট করতে কোনও সমস্যাই হচ্ছে না ব্যাটারদের।শাদাব খানের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বোলিং এভারেজ ৩৩.৫৭, গত দুই বছরে এটা ৩৭ এর মতো হয়ে গেছে।

এই বছরের শুরু থেকে আরও অবনতি হয়েছে, ২০২৩ সালে শাদাব খানের বোলিং গড় ৪২।শাদাব খান বল হাতে রঙ হারানোর ফলে পাকিস্তান ক্রিকেট দল ভুগছে।মূলত ২০১৮ সাল থেকেই কুচকির চোটে ভুগছেন শাদাব খান এবং তিনি যে অ্যাকশনে বল করেন সেটায় সামান্য পরিবর্তনও বড় প্রভাব রাখে।শাদাব খান আগের বোলিং করার গতিও কমিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট লেখক জ্যারড কিম্বারের মতে, “শাদাব খান অনেক বেশি টি-টোয়েন্টি খেলেন, যে কারণে তিনি অনেকটা টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হয়ে গেছেন।প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট তিনি বেশি খেলেননি। ওয়ানডে ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিতেও তার বেগ পেতে হচ্ছে এ কারণে।”হারিস রওফ এখনও পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে খরুচে বোলারদের একজন, তার ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যা বলে মনে করেন পাকিস্তানের কিংবদন্তী সাবেক ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম।

পাকিস্তানের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনার সময় ওয়াসিম আকরাম বলেন, “হ্যাঁ, শাহীনকে সময়ের অন্যতম সেরা বলা যায়। কিন্তু হারিস রওফ তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেনি, তাই ওয়ানডে ক্রিকেটে যে তার এই অবস্থা হবে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল।”হারিস রওফ গত ম্যাচে আট ওভারে ৮৩ রান দিয়েছেন। একটা পর্যায়ে তার বোলিং ফিগার ছিল চার ওভারে ৫৯ রান।পার্টটাইমার ইফতিখার আহমেদ ছাড়া পাকিস্তানের সব বোলারই ওভারপ্রতি পাঁচের ওপর রান দিয়েছেন।

হারিস রওফ দিয়েছেন ১০ এর ওপর, উসামা মির দিয়েছেন নয়ের ওপর। মোহাম্মদ নাওয়াজের ইকোনমিক রেট ছিল ৬.১৪, হাসান আলি দিয়েছেন ওভারপ্রতি সাত দশমিক ১২।তবে শেষদিকে বল হাতে নিয়ে শাহীন শাহ আফ্রিদি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন এবং তিনি ১০ ওভারে ৫৪ রান দিয়েছেন।

পাকিস্তান চলতি বিশ্বকাপে প্রথম চার ম্যাচে দুইবার সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি বা তার বেশি রান হজম করেছে।ভারতের বিপক্ষেও পাকিস্তানের বোলাররা তেমন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেননি।ওয়াসিম আকরামের মতে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে চার ওভার বল করা আর ওয়ানডে ক্রিকেটে ১০ ওভার বল করা যে আলাদা ব্যাপার এটা এবার টের পাচ্ছে পাকিস্তানের বোলাররা।

কোহলির বিশ্বকাপ এটা?

এখনও পর্যন্ত চলমান ক্রিকেট বিশ্বকাপে তেমন শ্বাসরুদ্ধকর কোনও ম্যাচ হয়নি, তবে কিছু মুহূর্ত পাওয়া গেছে এমন, যেমন কোহলির শতক হাঁকানো।এখন ম্যাচে ভারত জিতবে কি না তার চেয়ে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে কোহলি শতক পাবেন কি না।এখনও পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচেই রান পেয়েছেন ভিরাট কোহলি বাংলাদেশের বিপক্ষে শতক হাঁকিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছেন ৮৫, আফগানিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৫৫ এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করলেন ৯৫।

আরও দুটি শতক হতেই পারতো কিন্তু কোহলি যা করছেন এই বিশ্বকাপে তাতে তিনি বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার হওয়ার পথেই আছেন।এর আগের দিন পুনেতে দেখা গেছে গোটা স্টেডিয়াম কোহলির শতক উদযাপন করছিলো, এবার ধরমশালায়ও একই রকম দৃশ্যের মঞ্চায়ন হতে হতেও হলো না।কোহলি ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪৮টি শতকের মালিক, টেন্ডুলকারের ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরি ছুঁতে আর একটি শতক প্রয়োজন তার।

ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন তার টুইটে লিখেছেন, “বড় ক্রিকেটাররা সবসময়ই বিশ্বকাপে ভালো করেন। এটাই তাদের ফুটিয়ে তোলে। ভিরাট কোহলি রান তাড়ায় বিশ্বের সেরা ব্যাটার, আবারও তিনি প্রমাণ করলেন”।নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭৪ রান তাড়া করতে নেমে ভারতকে প্রায় জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন কোহলি, ১০৪ বলে ৯৫ রানের এই ইনিংসে ৮টি চার ও ২টি ছক্কা ছিল।ভারত এখনও পর্যন্ত টুর্নামেন্টের একমাত্র দল হিসেবে পাঁচ ম্যাচেই অপরাজিত।

সূত্র : বিবিসি