এটাই কি ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ?

এটাই কি ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ?

এটাই কি ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ?

ইডেনে শনিবারের রাতে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ততক্ষণে বাংলাদেশের আট উইকেট পড়ে গেছে, বলা যেতে পারে পরাজয়ের কাউন্টডাউন চলছে একরকম! গ্যালারিতে এক হতাশ বাংলাদেশ দর্শক একটা হাতে লেখা পোস্টার তুলে ধরলেন, “সব সময়ই আমাদের লক্ষ্য পরের বিশ্বকাপ!”হিন্দি কমেন্ট্রি বক্সে তখন ভারতের ক্রিকেট লেজেন্ড সুনীল গাভাসকার আড্ডা মারছিলেন সাবেক ক্রিকেটার ইরফান পাঠানের সঙ্গে।

পোস্টাররা চোখে পড়তেই প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন গাভাসকার। ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “আরে দ্যাখো দ্যাখো বাংলাদেশ কী বলছে!”তার পরেই রীতিমতো ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলেন, “আরে পরের বিশ্বকাপ তো অনেক দূরের কথা। আগে তো বাছাই পর্ব খেলে কোয়ালিফাই করো, তারপর না বিশ্বকাপ খেলবে!”

দু’জনেই এরপর হেসে গড়িয়ে পড়লেন – এবং একমত হলেন, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যা হতশ্রী পারফরম্যান্স তাতে পরের বার তারা মূল পর্বে খেলবেই এমন কোনও গ্যারান্টি নেই!ভারতে টেস্ট ক্রিকেটের কিংবদন্তী গাভাসকারের নিজস্ব ওয়ান ডে রেকর্ড বেশ খারাপ – বিশ্বকাপে পুরো ৬০ ওভার খেলে তার ৩৬ নট আউটের ইনিংস (স্ট্রাইক রেট ছিল ২০-র মতো) তো ভারতের ক্রিকেট লোকগাথার অংশ হয়ে আছে।

এই কারণেই কি না জানা নেই, ওয়ান-ডে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে গেলে সচরাচর তিনি একটু সতর্ক ভঙ্গীতেই বলে থাকেন।সেই গাভাসকারও যখন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কোনও সুযোগ ছাড়ছেন না – তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এবারের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে ক্রিকেট পন্ডিতরা কতটা অবজ্ঞার চোখে দেখছেন!

গাভাসকারের সেই ব্যঙ্গবিদ্রূপের ঘণ্টাখানেক পরে ম্যাচ-পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিজেও স্বীকার করে নিলেন, স্মরণকালের মধ্যে এটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বকাপ!“সেটা আপনারা হয়তো নির্দ্বিধায় বলতে পারেন (যে এটাই সবচেয়ে খারাপ বিশ্বকাপ)। আমি সে ক্ষেত্রে আদৌ দ্বিমত করব না”, একটি প্রশ্নের উত্তরে জানালেন সাকিব।

দল কেন এত বাজে খেলছে, ব্যাটাররা কেন একের পর এক ম্যাচে ডোবাচ্ছেন, কোনও পরিকল্পনাই কেন ঠিকঠাক কাজে আসছে না – এ সব প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছে নেই, সেটাও অকপটে স্বীকার করে নিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।বাংলাদেশ আইসিসির বিশ্বকাপে খেলছে সেই ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত টুর্নামেন্ট থেকেই – মানে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ারও বেশ আগে থেকে।

আর মাঝের একটি এডিশন বাদ দিলেই বিগত প্রতিটি বিশ্বকাপেই তারা কিন্তু দু’তিনটে ম্যাচে রীতিমতো চমক দিয়েছে – র‍্যাঙ্কিংয়ে অনেক ওপরে থাকা শক্ত প্রতিপক্ষদের হারিয়ে।১৯৯৯তে যেমন তারা পাকিস্তানকে হারিয়েছিল, ২০০৭ সালে ভারতকে ছিটকেই দিয়েছিল টুর্নামেন্ট থেকে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দলকেও তারা বিশ্বকাপে একাধিকবার হারিয়েছে। ২০১৫-তে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিশ্বকাপের নক-আউট স্টেজেও উঠেছিল।তাহলে পরিসংখ্যানের বিচারে এবারের বিশ্বকাপই কি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গ্লানিময় হতে চলেছে?

‘তদন্ত কমিটিকে ভয় পাই না’

বাংলাদেশের জন্য এবারের বিশ্বকাপের সঙ্গে একমাত্র তুলনা হতে পারে কুড়ি বছর আগে ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে পারফরমেন্সের।

প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই ১৯৯৯তে বাংলাদেশ কিন্তু পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়েছিল – অথচ এর চার বছর পরেই দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা গেল সম্পূর্ণ অন্য ছবি।সেবার পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ একটিও জয় পায়নি – বরং প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসা কানাডার কাছে ৬০ রানে ও আইসিসি-র সহযোগী সদস্য কেনিয়ার কাছেও ৩২ রানে হেরেছিল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ম্যাচটি বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত না-হলে সেবার গ্রুপ স্টেজে ছ’টি ম্যাচের সবগুলোতেই হয়তো বাংলাদেশকে হারতে হতো।এই চরম হতাশাজনক পারফরমেন্সের পর বাংলাদেশেও যখন ক্রিকেট সমর্থকদের প্রতিবাদ তুঙ্গে, তখনকার বিসিবি সভাপতি আলি আসগর লবি বিশ্বকাপে দলের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

বাংলাদেশ দল তখনও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরেনি। দেশে ফেরার বিমান ধরার আগে জোহানেসবার্গে বসেই ক্রিকেটাররা খবর পেয়েছিলেন, ঢাকায় নামার পরেই তাদের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হবে।সে সময় টিম হোটেলে বসেই বাংলাদেশ অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বিবিসি বাংলাকে একটি রেডিও সাক্ষাত্‌কার দেন।তখন তার পাশেই গোটা সময়টা বসেছিলেন টুর্নামেন্টে দলের ম্যানেজার, সাবেক ক্রিকেটার এ এস এম ফারুক।

সেখানে তদন্ত কমিটির কথা উঠতেই খালেদ মাসুদ পাইলট এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “দেখুন, বোর্ডের তদন্ত কমিটিকে ভয় পাই না। ওরা যা জানতে চাইবেন, বলব খোলাখুলি।“কিন্তু আমি ভয় পাই রাজশাহীর রিক্সাওলাদের। দেশে ফিরে যখন রাজশাহী যাব, ওরা নির্ঘাত বলবেন অমুক ম্যাচে তোমার ওই শটটায় পুল মারা উচিত হয় নাই – ওইটা ছাড়া দরকার ছিল!”

“তখন যে কী জবাব দিতে হবে, সেটা আমি সত্যিই জানি না!”, বাংলাদেশে ক্রিকেট-পাগল সমর্থকদের ক্ষোভ-অনুযোগ প্রসঙ্গে খানিকটা অসহায়ভাবেই সে দিন কথাটা বলেছিলেন পাইলট।মাসতিনেক পরে সেই তদন্ত কমিটি যখন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে তখন ব্যর্থতার আরো নানা কারণের সঙ্গে তারা কিন্ত ক্যাপ্টেনের ব্যক্তিগত আচরণ, বেশি রাত করে রুমে আসা, কোচ ও ম্যানেজারের সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত না-থাকা ইত্যাদি নানা কারণকেই দুষেছিল।

সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার মহসিন কামাল – বিশ্বকাপের পর যথারীতি তার চাকরি যায়।২০০৩ সালের সেই বিশ্বকাপ এখনও বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে আছে সন্দেহ নেই।তবে সদ্য টেস্ট মর্যাদা পাওয়া একটি দেশের জন্য সর্বোচ্চ মানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তখনও বেশ নতুন জিনিস, তাই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি ক্রিকেট অনুরাগী তাদের প্রিয় দলকে নিশ্চয় ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন।

এখন আবার তুলনা কেন?

বিশ বছর আগেকার সেই টুর্নামেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের এবারের বিশ্বকাপের আবার তুলনা হচ্ছে – কারণ সেবার তারা কানাডা ও কেনিয়ার মতো দলের কাছে হেরেছিল, আর গত রাতে বাংলাদেশ হেরেছে নেদারল্যান্ডসের কাছে।

এই সবগুলো দেশই আইসিসি-র সহযোগী সদস্য (অ্যাসোসিয়েট মেম্বার)- আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মর্যাদায় বা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অনেক নিচে তাদের অবস্থান।এদিকে বিশ বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছ থেকে সমর্থকদের চাহিদাও বহুগুণ বেড়েছে, ধারাবাহিকতার অভাব সত্ত্বেও নানা সময়ে দারুণ খেলে দলের ক্রিকেটাররাই সেই প্রত্যাশাকে গগনস্পর্শী করেছেন।

অথচ এবারের বিশ্বকাপে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটি বাদ দিলে এখনো পর্যন্ত বাকি পাঁচটি ম্যাচের সবগুলোতেই বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হেরেছে, জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি তারা।সম্ভবত এই পটভূমিতেই সাকিব আল হাসানও মেনে নিচ্ছেন, এত খারাপ বিশ্বকাপ বাংলাদেশ আগে কখনো খেলেনি। এই মন্তব্য করার সময় ২০০৩ এডিশনের কথা নিশ্চয় তিনি মাথায় রেখে বলেননি, ধরেই নেওয়া যায়।

সেবারে একটিও জয় না-পেলেও এবারে কিন্তু ধরমশালায় আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রীতিমতো ভাল খেলেই জিতেছে।কিন্তু এরপর লাগাতার ব্যর্থতা তিন সপ্তাহ আগের ম্যাচটিকে স্মৃতি থেকে এক রকম মুছেই ফেলেছে বলা যেতে পারে।এখনও টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের বাকি রয়েছে তিনটি ম্যাচ – পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে কোনও একটি অন্তত জিততে পারলে বাংলাদেশ নিশ্চয় কিছুটা ‘সান্ত্বনা’ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবে এবং এই বিশ্বকাপকে হয়তো তাদের জন্য ‘সবচেয়ে খারাপ’ বলে চিহ্নিত করা হবে না।

বছর দেড়েক বাদে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জনের জন্য ওয়ান-ডে র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথম আটে থাকতেই হবে, সেই লক্ষ্যেও এই ম্যাচগুলোতে জেতা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।তবে এই মুহুর্তে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা যে ‘শুধু কঠিন নয়, খুব খুব কঠিন’, সাকিব নিজেও সে কথা মেনে নিলেন।

এবং এটাও জানালেন, ছ’টা বিশ্বকাপ খেলে ফেলার পরও কেন বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠতে পারল না সেই উত্তর সত্যিই তার কাছে নেই!“হয়তো আপনারা ভুল লোককে এই প্রশ্নটা করছেন। হয়তো এর অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এখন সেগুলো আলোচনা করার সময় নয়”, জানালেন তিনি।

ক্যারিবিয়ানে আয়োজিত ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আসলে একটা দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছিল – যেখানে তারা বড় বড় প্রতিপক্ষর কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে শুরু করে এবং একের পর এক তথাকথিত ‘আপসেট’ ঘটাতে থাকে।২০২৩য়ে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এখন আবার সেই প্রাক-২০০৭ পর্বে ফিরিয়ে নিয়ে যায় কি না, সেই আশঙ্কাই সমর্থকদের মধ্যে চেপে বসতে শুরু করেছে!

সূত্র : বিবিসি