ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না বিশ্বাসীরা

ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না বিশ্বাসীরা

প্রতিকী ছবি

একবার তকদির প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম, ‘বিশ্বাসীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না।’ ওয়াজ শেষে ইংরেজি সাহিত্যের একজন অধ্যাপক বললেন, ‘তকদির কি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করতেও নিষেধ করে’ মুচকি হেসে বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব! দুশ্চিন্তা আর পরিকল্পনা দুটো বিষয়ের ফারাক আকাশ-পাতাল। ইসলাম ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছে ঠিক, কিন্তু পরিকল্পিত জীবনযাপনে দিয়েছে উৎসাহ। দুশ্চিন্তা আর পরিকল্পনা আপনি অবশ্যই এক বলবেন না।’ এবার প্রফেসর সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘এবার বুঝতে পেরেছি। থিংকিং আর ওভার থিংকিং বলে একটা কথা আছে। থিংকিং নরমাল। ওভার থিংকিং এবনরমাল। ভেবেচিন্তে কাজ করা এক ব্যাপার। চিন্তাভাবনার সমুদ্রে ডুবে মরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।’ তকদিরের আলোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ হয়রান হয়ে পড়েন। মনে করেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করা বোধহয় তকদিরবিরোধী চিন্তা। আসলে বিষয়টা তা নয়। আমরা যদি আল্লাহর জগৎ পরিচালনার নিয়ম সম্পর্কে মোরাকাবা-মোশাহাদায় বসি, তাহলে দেখতে পাব জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে রয়েছে ভেবেচিন্তে পরিকল্পিত কাজের শিক্ষা। সন্তান দুনিয়ায় আসার আগে আল্লাহ মায়ের বুকে সন্তানের খাবার জমা করে রাখেন। শীত আসার আগে আগে শীত মেটানোর সরঞ্জাম আল্লাহ বান্দার জন্য তৈরি করে রাখেন। শীতে আল্লাহ এক ধরনের সবজি দেন, গ্রীষ্মে দেন আরেক ধরনের। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, কোনো মানুষ যদি নিয়মিত শুধু মৌসুমি ফলমূল-শাকসবজি খায় তাহলে সেসব ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকবে। পরিকল্পিত জীবন তাওয়াক্কুলের বিপরীত নয়। আমরা দেখতে পাই আল্লাহ হজরত মুসাকে (আ.) ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচার জন্য রাতের আঁধারে পালাতে আদেশ করেছেন। আবার সে মুসা নবীই যখন সমুদ্রের সামনে এসে আটকে গেলেন তখন আল্লাহ কুদরতিভাবে সমুদ্রের বুকে পথ করে দিলেন। আল্লাহ চাইলে কিন্তু মুসা নবীকে দিনের আলোতে বুক ফুলিয়ে ফেরাউন বাহিনীর সামনে দিয়ে চলে আসার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ সেটা করেননি মানুষকে পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণের শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

একই বিষয় দেখতে পাই আমাদের পেয়ারা নবীজি (সা.)-এর জীবনে। হিজরতের রাতে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। চারদিকে কাফেরের দল তাঁকে খুন করার জন্য খোলা তলোয়ার হাতে ঘুরছে। নবীজি (সা.) আল্লাহর ওপর ভরসা করে এক মুঠো বালু হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিলেন। সে বালু উপস্থিত সব কাফেরের চোখে গিয়ে তাদের সাময়িক সময়ের জন্য অন্ধ করে দিল। এখান থেকে বেরিয়ে নবীজি (সা.) আবু বকরের (রা.) বাড়ি গেলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মদিনার পথ ধরলেন। এক ইহুদিকে নিলেন গাইড হিসেবে। গাইডকে বললেন মক্কা থেকে মদিনার পরিচিত পথ নয় বরং উল্টো পথে যেন তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে কিন্তু নবীজি কৌশল ও পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। আবার যখন একটু পরেই গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন আর কাফেররা গুহার মুখে চলে এসেছে তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘আবু বকর! ভয় পেও না। আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন।’ অর্থাৎ একদিকে তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করছিলেন অন্যদিকে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। এটাই আসলে সত্যিকারের জীবনাদর্শ। যেখানে মানুষ সব তকদির-তাওয়াক্কুলের ওপর ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। আবার নিজের বুদ্ধি-চেষ্টার ওপরও শতভাগ নির্ভর করে আল্লাহর জিম্মা থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

বলছিলাম, বিশ্বাসীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও ভয়ংকর ব্যাপার। আমার চাকরি চলে গেলে খাব কী আমার দুরারোগ্য ব্যাধি হলে কী হবে ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙে পড়লে কোথায় থাকব পড়াশোনা শেষে চাকরি না পেলে কীভাবে জীবন কাটাব এমন হাজারো উদ্ভট চিন্তা মাথায় এসে এমনভাবে বাসা বাঁধে, এক পর্যায়ে মানসিক রোগ পর্যন্ত হয়ে যায়। এ ধরনের অলীক চিন্তা তকদির ও তাওয়াক্কুলের বিপরীত। কারও যদি এমন চিন্তা মাথায় আসে তখন বলতে হবে, আল্লাহ তকদিরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। আধ্যাত্মিক গুরু বদিউজ্জামান সাঈদ নূরসি (রহ.) দোয়া ইউনুসের হেকমত আলোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘কখনো কখনো বিপদাপদও আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার। কিন্তু আমরা না বুঝে সে বিপদকেই গজব মনে করি। বিপদে পড়লে মানুষ আল্লাহকে অনবরত ডাকতে থাকে। কিন্তু সুস্থ ও সচ্ছল অবস্থায় অনেক মানুষই আল্লাহকে ডাকে না। তাই কেউ যদি ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে এই ভয়ে সর্বক্ষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে তাহলে তার চিকিৎসা এই যে, সে নিজেকে সান্ত্বনা দেবে এভাবে, নিশ্চয় ওই বিপদের মধ্যে আমার কল্যাণ রয়েছে। তাই যাই হোক না কেন, আমি সেখানে আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টির মধ্যেই থাকব।’ নূরসি বলেছেন, আগামী মাসে ক্ষুধা লাগবে, পিপাসা লাগবে এই ভয়ে যে ব্যক্তি এ বেলায় অগ্রিম বেশি বেশি খেয়ে রাখতে চায়, তাকে আমরা যতটা বোকা মনে করব; অদূর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় এখন যে নিজের সুখশান্তি নষ্ট করছে সে তার চেয়েও বড় বোকা এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে যা হয় তা দেখা যাবে। আল্লাহ আমাকে এখন যেভাবে চালাচ্ছেন আগামী দিনগুলোতে আরও ভালো রাখবেন এ বিশ্বাস নিয়েই আমাদের নিত্যজীবন এগিয়ে নিতে হবে। আশা করি, এর ফলে আমাদের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আশঙ্কা বা ভয় সেটা আর থাকবে না। আল্লাহ আমাদের ভিতর জগৎ নূরানি করে দিন। আমিন।
 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীরসাহেব, আউলিয়ানগর