নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার জন্য আজই কি শেষ দিন?

নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার জন্য আজই কি শেষ দিন?

নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার জন্য আজই কি শেষ দিন?

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেবার শেষ দিন আজ। ক্ষমতাসীন দল যখন জোর কদমে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন মনোনয়নপত্র জমা দেবার শেষ দিনে আজ হরতাল কর্মসূচী পালন করছে বিএনপি।নির্বাচন কমিশন আজ মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় বৃদ্ধি না করলে বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকবে।

অনেকের মনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে – বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কিংবা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আজই কি শেষ দিন?একাধিক নির্বাচন কমিশনার এরই মধ্যে বলেছেন যে বিএনপি নির্বাচনে আসলে তফসিল পিছিয়ে দেবার বিষয়টি চিন্তা করা হবে।কিন্তু এখনো পর্যন্ত দলটির সিনিয়র নেতাদের অনেকেই কারাগারে। নির্বাচনের জন্য যে ধরণের প্রস্তুতি দরকার সেটি বিএনপির মধ্যে দৃশ্যমান নয়।

সমঝোতার শেষ দিন আজ?

বাংলাদেশে অতীতের নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সাধারণত ৪৫ দিন পর্যাপ্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবার তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের তারিখ পর্যন্ত আরো এক সপ্তাহ বেশি সময় রয়েছে।নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে বলেছে, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদপূর্তির আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে।

সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের তারিখ আরো দু-সপ্তাহ পিছিয়ে দিলে সংবিধানের কোন বরখেলাপ হবে না বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, নির্বাচন কমিশন চাইলে তফসিল ডিসেম্বরের ১২ তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে পারে।কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে মনোনয়নপত্র জমা দেবার সময় বাড়িয়ে কোন লাভ হবে কি না?

তিনি বলেন, বিএনপির অর্ধেকের বেশি নেতা-কর্মী কারাগারে। তাহলে কার সাথে সংলাপ হবে?তাহলে সমঝোতা করার জন্য আজই কি শেষ দিন?শাহদীন মালিক মনে করেন, বাস্তবতার নিরিখে সেটাই মনে হচ্ছে। “তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে আরো দু’সপ্তাহ সময় আছে। কিন্তু ওটা প্র্যাকটিকাল না, কারণ কার সাথে বলবে? নেতাই তো নেই। আর বিএনপির সমমনা দলগুলোরও তো এক দাবি।”এখনো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে সমঝোতার আভাস দেখা যাচ্ছে?

এমন প্রশ্নে শাহদিন মালিক বলেন, “না, সার্বিক রাজনৈতিক আবহাওয়া সংলাপের কোন ইঙ্গিতই দিচ্ছে না।”বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এর আগে যতবার তফসিল পেছানো হয়েছে সেটি ঘটেছে মনোনয়নপত্র জমা দেবার শেষ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে।

মনোনয়নপত্র জমা দেবার শেষদিন অতিক্রান্ত হবার পর তফসিল পেছানোর নজির নেই। আর সেক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য আজই শেষ দিন বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকে।নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা যদি ইতিহাস অনুসরণ করি তাহলে আজকের পরে নির্বাচনের তফসিল পেছানোর সুযোগ নেই।”তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে তফসিল বাতিলও করতে পারে। কমিশনের সে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আছে বলে মি. আলীম উল্লেখ করেন।

তিনি বলছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেবার শেষ দিন অতিক্রান্ত হবার পরেও নির্বাচন কমিশন চাইলে সে সময় বৃদ্ধি করতে পারে।“ইচ্ছা করলেই সেটা করতে পারবে। কারণ এখানে আইনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই যে সেটা করা যাবে না,” বলেন মি, আলীম।গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি দফায় দফায় অবরোধ-হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। আজও দেশ জুড়ে বিএনপির হরতাল কর্মসূচী রয়েছে।

ফলে সমঝোতার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী।“তাদের যে রাজনৈতিক কর্মসূচী তা দেখে তো মনে হচ্ছে যে তারা হয়তো সাড়া দেবে না এই মুহূর্তে।”তাহলে ৩০শে নভেম্বরই কি একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য শেষ দিন?“এটা বলা খুব কঠিন। রাজনীতি তো একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস (ধারাবাহিক প্রক্রিয়া)”, বিবিসি বাংলাকে বলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী।

নির্বাচন কমিশন কী বলছে?

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সমঝোতার সময় যখন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তখন কূটনৈতিক তৎপরতাও থেমে নেই।ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এবং ইউরোপের আরো সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা বুধবার নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক করেছেন।

বৈঠক শেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, তারা গণতান্ত্রিক, বিশ্বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করেন।অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন আইনত এবং সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।

“আমরা আগের মতো স্পষ্ট করে বলেছি যে আমরা নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার, পিসফুল এন্ড ক্রেডিবল - এটা যাতে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,” বুধবার সাংবাদিকদের বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।“আমার বিশ্বাস আমাদের যে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সেটা তারা বুঝতে পেরেছেন।”“রাজনৈতিক অঙ্গনে যদি কোন মতবিরোধ ধাকে, কোন বিভেদ থাকে, কোন বিভাজন থাকে সেখানে আমরা কোনভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারিনা,” বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

কী বলছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনো পর্যন্ত তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে।বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল পেছানো হবে কি না সেটি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কারণ, তারা নির্বাচনের তফসিল পেছানোর জন্য আন্দোলন করছেন না। তারা মনে করেন, নির্বাচনের তফসিল পেছালেই ‘রাজনৈতিক অচলাবস্থা’ দূর হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের দল আন্দোলন করছে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যে, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যে, মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে এবং সর্বোপরি এদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে।“এসব কিছু পরিবর্তন আনবার জন্যে যে প্রক্রিয়া অপরিহার্য তা হলো একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সকলের জন্যে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন। কেবল মনোনয়ন জমা দেয়ার তারিখ পরিবর্তন করলেই তা অর্জিত হয়ে যাবে না”, বলেন ড. খান।

এদিকে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময়সীমা আছে। সে সময়সীমা অতিক্রম করে তফসিল পরিবর্তন তারা কখনো সমর্থন করবেন না।“এই সময়সীমাকে অতিক্রম করবে, এমন কোন পদক্ষেপ , এমন কোন পরিবর্তন আমরা কখনো সমর্থন করবো না,” বলেন মি. কাদের।সংবাদ সম্মেলনে মি. কাদের নির্বাচন নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতারও সমালোচনা করেন।

“আজকে যারা মানবাধিকারের কথা বলে বাংলাদেশে, সুশাসনের কথা বলে, যারা ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশনের কথা বড় গলায় কথা বলে – তারা আজকে একটা পক্ষের অপকর্ম, অত্যাচার, গণতন্ত্র বিরোধী, সংবিধান বিরোধী অ্যাকটিভিটিজ (কর্মকাণ্ড) সম্পর্কে কেন নীরব?”, প্রশ্ন তোলেন মি. কাদের।“এখন কেউ কিছু বলে না। ইউরোপও কিছু বলেনা, আমেরিকাও কিছু বলে না।”আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, “পুলিশকে যে মেরেছে তাকে গ্রেফতার করবে না? এই হত্যাকারীদের বিচার কি হবে না?"প্রধান বিচারপতির বাড়িতে যারা হামলা করেছে তাদের বিচার হবে না? পুলিশ হাসপাতালে যারা হামলা করেছে তাদের বিচার হবে না? গাড়ি পোড়াচ্ছে প্রকাশ্যে, ধরা পড়ছে – তাদের কি বিচার হবে না? ”

সূত্র : বিবিসি